এ বছরই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন টমাস ট্রান্সট্রোমার। ওর জন্ম স্টকহোমে ১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল। বাবা গোস্তা ট্রান্সট্রোমার ছিলেন সাংবাদিক, মা হেলমা ট্রান্সট্রোমার শিক্ষয়িত্রী। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স করার পর বেছে নেন মনোবিজ্ঞানীর জীবিকা। প্রথম কবিতার বই 'সতেরোটি পদ্য' প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সুইডিশ কবিতার ভুবনে স্থায়ী হয়ে যায় তার আসন। ট্রান্সট্রোমারের প্রথম দিককার লিরিকগুলো লেখা হয়েছিল অনেকটা ধ্রুপদী ঢঙে। পরে যত দিন গেছে ঝুঁকেছেন গদ্যকবিতার দিকে। তবে কখনই খুব জাঁক করে কথা বলেন না, বলেন নিচু স্বরে। কিন্তু গভীর সেই স্বরায়ণ। অনেকটা নিঃশব্দে অনিবার্য শব্দের সহযোগে নির্মাণ করেন কবিতা। তার কবিতার বিষয়আশয় বস্তুজগত নয়, অনুভূত অবভাসিক জগত। মনোজাগতিক আত্মনির্মিত প্রতিমার সাহায্যে তিনি রচনা করেছেন এক-একটি কবিতা। তার কবিতার ভুবনও সুইডেনের দ্বীপাঞ্চল, পাহাড়, বন-বনানী, পাখি, কীট-পতঙ্গ আর চারপাশের ছড়ানো ভূদৃশ্য। তার দেখার চোখটিও খুবই তীক্ষ্ম।  ছোট ছোট নানা বিষয়, যা অন্যদের প্রায় চোখেই পড়ে না, ট্রান্সট্রোমারের চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি। তবে এই দৃশ্যমান পৃথিবী নয়, অজস্র অবিরল ইমেজ বা প্রতিমার সাহায্যে পরাপৃথিবী বা পরাজগত নির্মাণ করে কবিতা লিখে গেছেন তিনি। মনোজাগতিক গহনলোকের কথা আর পরাবাস্তবময় পরিমিত বর্ণনার মিশ্রণে অপূর্ব তার কবিতাবিশ্ব। ১৯৯০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পর থেকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন এই কবি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : সতেরোটি পদ্য (১৯৫৪), গোপনে পথে (১৯৫৮), অর্ধসমাপ্ত স্বর্গ (১৯৬২), পনেরোটি পদ্য (১৯৬৬), অন্ধকারে দেখা (১৯৭০), নৈশদৃশ্য (১৯৭১), জানালা ও পাথর (১৯৭২), পথ (১৯৭৩), বাল্টিক (১৯৭৪), সত্যের পথে বাধা (১৯৭৮), নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৯), নতুন নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৭), কাব্যসংগ্রহ (১৯৮৮), জীবিত আর মৃতদের জন্য (১৯৮৯), কত বড় ধাঁধা : নতুন নির্বাচিত কবিতা (২০০৬)।



সকালের পাখি

আমি ঘুম থেকে গাড়িটাকে জাগিয়ে তুললাম
এই গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনটা পুষ্পরেণু দিয়ে রঙ করা।
আমি আমার রোদচশমা চোখে দিলাম।
পাখিদের গান অন্ধকারে ডুবে গেল।

এরই মধ্যে আরেকটি লোক রেলস্টেশন থেকে
একটা খবরের কাগজ কিনল
চলে এল মালবোঝাই ওয়াগনের কাছাকাছি
ওয়াগনটি একেবারেই লাল আর মরচে-ধরা
সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে ঝলমল করে কাঁপছে।

এখানে কোথাও কোনও শূন্য জায়গা নেই।

একেবারে সোজা বসন্তের ভেতরে উষ্ণ একটা শীতল করিডর
কে যেন সেখান থেকে দৌঁড়ে আসছে
বলছে কী করে তারা তার বিরুদ্ধে হেড অফিসে
নালিশ জানিয়ে এল।

ল্যান্ডস্কেপের পেছন দরোজা দিয়ে
একটা চড়ুই পাখি উড়ে আসছে
কালো আর শাদা, আরও কত-কি পাখি।
কালো ওই পাখিটা চারকোলের ড্রইং হয়ে ওঠার আগ-পর্যন্ত
কেবলই উড়ে যাচ্ছে আর আসছে,
ধোপাবাড়িতে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষমান শাদা কাপড়গুলি ছাড়া :
বেজে চলেছে প্যালেস্ত্রিনা কোরাস।

এখানে কোথাও কোনও শূন্য জায়গা নেই।

দারুণ উপভোগ করছি আমি কীভাবে তৈরি হচ্ছে আমার কবিতা
যদিও আমি নিজে ডুবে যাচ্ছি গভীর অতলে।
হচ্ছে, কবিতাটা হচ্ছে, নিয়ে নিচ্ছে আমারই জায়গা।
ধাক্কা দিয়ে আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
নীড় থেকে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে বাইরে।
কবিতাটা এখন প্রস্তুত।

(‘ধ্বনি এবং পথরেখা কাব্যগ্রন্থ’ থেকে)




শূন্যস্থানে

বনের মাঝামাঝি, ভাবাই যায় না, একটা চমৎকার ফাঁকা জায়গা আছে, জায়গাটা শুধু
তারাই খুঁজে পায় যারা হারিয়ে যায়।
এই ফাঁকা জায়গাটা একটা বন দিয়ে ঘেরা, যে নিজেই দমবন্ধ হয়ে হাঁসফাস করে। কালো
গুঁড়ি, গায়ে স্যাঁতসেঁতে ছোপ। বনের চূড়ায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো মৃত;
আছে শুধু কিছু নিঃসঙ্গ সবুজ শাখা, ছুঁয়ে দিচ্ছে আলো। নিচে : ছায়ারা শুয়ে আছে ছায়ার উপরে,
বাড়ছে শ্যাওলা।
তবে ওই ফাঁকা জায়গার ঘাসগুলো কী অদ্ভূত সবুজ আর জীবন্ত। বড় বড় পাথর
জায়গাটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, যেন ওভাবেই ওদের দাঁড়িয়ে থাকবার কথা ছিল।
এই পাথরগুলো হতে পারত যে-কোনও বাড়ির ভিত্তিস্থাপনের প্রস্তর, আমার হয়তো
ভুলও হতে পারে। কে থাকে ওখানে? কেউ নেই যে সাহায্য করবে। যাদুঘরের কোথায় যেন
ওই নামটি ঘুমাচ্ছে, কেউ খুলে দেখে না (শুধু যাদুঘর সবসময় তরুণ থাকে)।
মৌখিক ঐতিহ্য আজ মৃত, সেই সঙ্গে মরে গেছে সব স্মৃতি। জিপসিরা, গোত্রের মানুষেরা
স্মরণে আনতে পারে, কিন্তু যারা লিখতে জানত তারা ভুলে গেছে। লিখে রাখো আর ভুলে যাও
একে।
এই ছোট্ট বাড়ি ফিসফিস করে, হামা দেয়। এটাই পৃথিবীর কেন্দ্র। কিন্তু এই বাড়ির
মানুষেরা মরে যায় অথবা সরে যায় দূরে। ইতিহাসের এখানেই সমাপ্তি। জায়গাটা বছরের পর
বছর খালি থেকে যায়। আর তার খামারবাড়ি রূপান্তরিত হয়ে যায় স্ফিংসে। পরিশেষে
এই ভিত্তিস্থাপনের পাথরগুলো ছাড়া সবকিছু দূরে চলে যায়।
আগেই আমি এখানে কোনওক্রমে চলে এসেছি, কিন্তু সময় হয়েছে বিদায় নেবার। আমি
কণ্টকাকীর্ণ জঙ্গলে ঝাঁপ দেই। তুমি যদি এখান থেকে বের হতে চাও তাহলে তোমাকে
দাবার গুটির মতো এক পা এগিয়ে দু-পা পাশে সরে আসতে হবে। ধীরে ধীরে কমে আসবে
এই বনের ঘনত্ব আর আলো ফুটবে চোখে। আমার পদক্ষেপ দীর্ঘতর হচ্ছে। একটা পথ
একবার পেছনে আরেকবার সামনে করতে করতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
আমি যোগাযোগ নেটওয়ার্কের একেবারে পেছনে রয়ে গেছি।
শিখরস্পর্শী উঁচু বিদ্যুৎবাহী খাম্বার উপরে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা সূর্যের দিকে মুখ করে বসে আছে।
তার ঝিকিমিকি-কাঁধের নিচে উড়ন্ত পাখা এমনভাবে গোটানো যেন কোনও দক্ষ প্যারাশুটার লোটাকম্বল
নিয়ে অপেক্ষমান।

(অর্ধসমাপ্ত বেহেশত : টমাস ট্রান্সট্রমারের শ্রেষ্ঠ কবিতা থেকে)




খোলা জানালা

এক সকালে
দোতলার একটা খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে
আমি শেভ করছিলাম।
রেজর চালিয়ে দিতে
ওটা গুনগুন করতে শুরু করল।
ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল তার ঘূর্ণন।
একসময় মনে হল গর্জন করে উঠল।
দেখতে দেখতে রেজরটা একটা হেলিকপ্টারে পরিণত হলো।
তারপর একটা কণ্ঠস্বর—পাইলটের—তীক্ষ্ম ঝাঁঝালো
শোরগোল, চিৎকার :
“চোখ খোলা রাখো তোমার!
এইসব যা কিছু তুমি দেখছ, শেষবারের মতো দেখছ।”
গোলাপ।
গ্রীষ্মের ওপর দিয়ে দারুণ আন্দোলিত হয়ে বয়ে চলেছে।
ছোট ছোট যা কিছু, আমি ভালোবাসি খুব। কী-ই বা মূল্য তাদের?
সবুজের কত যে বৈচিত্র্য।
বিশেষ করে বাড়ির দেয়ালের লাল রঙটা কী দারুণ।
কাঁচপোকারা গোবরের উপরে ঝিলমিল করে উড়ছে, ঝলমল করছে সূর্যের আলোয়।
শুঁড়িখানাগুলো যেন শিকড়চ্যুত হয়ে
বাতাসে পাল তুলে উড়ে চলেছে।
শিল্পকারখানা।
ছাপাখানাটা একা একাই হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে।
এই মুহূর্তে শুধু মানুষই একমাত্র বস্তু
যা স্থির, অনড়, নড়ছে না একটুও।
বিশেষ করে চার্চের সামনের খোলা জায়গায় রাখা মৃতদেহটি
পুরোপুরি স্থির
মনে হচ্ছিল ওই লাশটি বুঝি ক্যামেরায় ছবি তোলার
প্রথম দিককার দিনগুলোতে একটা মানুষ যেভাবে পোজ দেয়
সেইভাবে পোজ দিচ্ছে।
ওড়ো, আরও নিচু হয়ে!
জানি না কোন পথে যাব আমি
মাথাটা ঘোরাব—
একটা ঘোড়ার মতো
আমার দৃষ্টি এখন দ্বিখণ্ডিত।

(‘বন্ধু, তুমি পান করেছ কিছু অন্ধকার’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)




অনুসৃতি


রাত্রি দুটো। চাঁদের আলো। মাঠের
বৃষ্টি থেমে গেছে। দূরে একটা শহরে আলোর ঝলকানি,
দিগন্তের উপর ঠান্ডা হিম টিমটিম করে জ্বলছে।
একটা মানুষ দৃষ্টি ফিরে পাবার পরেও
স্বপ্নের একেবারে অতলে ডুবে যেতে যেতে
কখনই মনে করতে পারবে না কোনওকালে সে ওইখানে ছিল।
অথবা কোনও মানুষ যখন অসুখের গভীরে ডুবে যেতে থাকে
তার দিনগুলো মনে হতে পারে টিমটিম করে জ্বলছে, যেন একটা মৌমাছি
দিগন্তের মাঝখানে নিস্তেজ আর হিম হয়ে আছে
ট্রেনটা একেবারেই স্থির।
রাত দুটো : তীব্র চাঁদের আলো, ছড়ানো কিছু নক্ষত্র।
চাপে পড়ে
নীল আকাশের নিষ্কর্মা ইঞ্জিনটা বধির হয়ে গেছে।
ভয়ে কম্পমান একটা কাজের জায়গায় আমরা বাস করি
সমুদ্রের গভীরতা যেখানে হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে
শামুকের খোল আর টেলিফোনের হিসহিস।
সুন্দরকে আমরা শুধু পাশ থেকে দেখতে পারি, দ্রুত।
মাঠে ঘন শস্য, হলুদ প্রবাহের কত যে রঙ।
আমার মাথার শ্রান্তিহীন ছায়া এইখানে ফুটে উঠছে।
ফসলের মধ্যে ওরা জন্ম নিতে চাইছে আর সোনা হয়ে উঠছে।
অন্ধকার নেমে এল, মধ্যরাতে আমাকে বিছানায় যেতে হবে।
বড় বড় নৌকাগুলোর কাছ থেকে ছোট নৌকাগুলো সরে যাচ্ছে।
পানিতে তুমি একা।
সমাজের ঘন কালো জাহাজের মাস্তুল সরে যাচ্ছে দূরে আরও দূরে।

(নির্বাচিত কবিতা : ১৯৫৪-১৯৮৬ কাব্যগ্রন্থ থেকে)