Always be a poet, even in prose. ~ Charles Baudelaire

 

মজনু শাহের  “জেব্রামাস্টার’’, চতুর্থ কবিতাগ্রন্থ অক্ষরবৃত্তের ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা, গদ্যকবিতার ঈসথেটিকাল এন্ড।

সমকালীন কবিতার যে লাইট-ইয়ার তার দৈর্ঘ্য ১৯৮০-২০১০ খৃষ্টাব্দ। এই লাইট-ইয়ারে কবিতার যা কিছু মহান প্রাপ্তি তা হলো উপন্যাস-বাস্তবতার কবিতা। উপন্যাস-বাস্তবধর্মময়তা এই আলোবর্ষের কবিতার প্রধান অবলম্বন। এই উপন্যাস-ধর্মত্যাগী কবিতা এই সময়ে উল্লেখযোগ্যতাহীন বা বলা যেতে পারে সেই সময়ের কবিদের দ্বারা নাকচকৃত এই গুণাগুণ স্লো-পয়জনের মত তাদেরকে খরচের খাতায় ফেলে রেখে গেছে। ফলে সময়ের দাবি কর্তৃক লেখকেরা পরাজিত, পরাজিত হয় প্রতি যুগে যুগে, অব্দে অব্দে; ফলে সময়ে সময়ে নব ধারা আর নব ভাবের আবির্ভাব, নয়া কবিতার সৃষ্টি। যে কবি সময়ের দাবির এই গোপন আকাক্সক্ষা উপেক্ষা করে লিখে যেতে চায় তারা এপিক কবিতার স্বচ্ছতার নীচে কাদার মত স্থির নির্জনতায় পড়ে থাকে, অনুরণনহীন। এই পতন-পথের নাম দিলাম এপিকলয়। এই মহারসদের এপিকলয় থেকে, মৃত ঐতিহাসিক কবিতার পঙ্ক থেকে গড়ে ওঠে নীলপদ্মের ব্যাকরণ, সেই পদ্ম-শরীর থেকে শত শত ড্রাগনের মুখ ছড়িয়ে চলেছে লিকলিকে আগুনের শিখা, নীল তাই তার রং।  এই পদ্ম-মশাল হলো কবিতার নতুন সম্রাজ্য-শাসক। এই শাসকের দণ্ডের চিনে বসে মহান কবি লিখে চলে আলো-কবিতা। সময়টাকে উপলব্ধি করা কবির জন্য জরুরি।

যাকে বললাম আলোকবর্ষের কবিতা, যার গুণাগুণ উপন্যাস-বাস্তবতা, তার কী বা রূপ?

উপন্যাস-বাস্তব কবিতার ভূগোল জনপদময়, বিজ্ঞানসূত্রমুখর, কল্পিত আখ্যান-নির্ভর, চিরসত্য সন্ধানী, এপিকময়, বহুদর্শী , কেন্দ্রপ্রত্যাশাগামী। সোজা কথায় এই কবিতা  সেই সোনালী লতাবৃক্ষ যা কল্প-কাহিনী-গাছের শাখায় নিজেকে বিকাশ করে। এবং এই সময়ের লিখিত কাব্য-সাফল্য অর্জনকারী কবিতাগুলো এই উপন্যাসিক ধারাতেই রচিত। ৮০-৯০ এর সফল কাব্যগ্রন্থগুলোর দিকে তাকালে এই জাতীয় কবিতার আখ্যাননির্ভর সাফল্যগাথা চোখে পড়ার মত। এই সমস্ত সফল কাব্যগ্রন্থের আবিষ্কারক পাঠক আপনি নিজেই। এই সময়ের কবিতার সফল কবিতা কিছু ব্যতিক্রম বাদে আখ্যানবাহক। আর এই কথা বলা যায় যে, এই আখ্যানের অনুশাসনই কবি কর্তৃক সময়ের মূল্যদান, যা মহান কবিদের করে যেতে হয় এপিকের স্বর আয়ত্তে আনার জন্য। তবে কবির সংগ্রাম কার বিরুদ্ধে? কবির সংগ্রাম সময়কে ধরতে না পারার বিরুদ্ধে, কবির সাধনা সময়-তরলের ভেতর সাঁতার শেখার, কবির ধ্যান সময়ের প্রবাহমানতার আওয়াজ শোনার, কবির নির্জনতা নিজেকে চেনার।

আর অ-উপন্যাসধর্মী কবিতা  হলো ব্যাপ্তিহীন বিস্তারময়, নির্জন একামুখী, বিকল্প-বিজ্ঞানসূত্রমুখর , বিকল্প নয়, সত্যহীন, বিশ্বাসনির্ভর, এপিকময় , পরিধিমুখর।

মজনু শাহ  ম্যাজিক আর মাস্টারির কবি। বিগত উপন্যাসিক নন্দনত্বত্তের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাংলা কবিতার নন্দনকাননে তিনি সুদক্ষ ড্রামবাদক যে কিনা অতি চর্চায় বাংলা কবিতার পর্দাটাই ছিড়ে দিলেন। বলা যায় এখান থেকে ২০১০ পরবর্তী কবিতার নন্দনত্বত্তের শুরু যা অ-উপন্যাসিক। এই বৈশিষ্ট্যের তীব্ররূপ দেখা দিলো জেব্রামাস্টার-এ। একটা সময়ের মৌল বৈশিষ্ট্যের বাইরে বিরাজমান উপেক্ষিত উপাদানগুলোর কোলাজ এই জেব্রামাস্টার। ফলে সময় স্বয়ং এই নয়া নন্দন তৈয়ার করে নিজ পরিবর্তনের প্রয়োজনে। কাহিনীর বিপরীতে মজনু শাহ আনুষ্ঠানিকতাময়, তার বয়ানকে বিশ্বাস করে নিতে হয়, তার ভূগোল আত্ম দ্বারা পরিকল্পিত যেখানে আমরা মাত্র পর্যটকের মত প্রবেশ করতে পারি, বিপুল বিস্ময়ে বুঝে উঠতে পারি আমরা পৌঁছে গেছি সেইখানে যেখানে কিছুই ঘটে চলে না। দৃশ্যে পর দৃশ্যের আসা যাওয়ার মাঝে, ইমেজের গাঢ় দ্রবণের মধ্যে দ্রবীভূত হয় পাঠক। সময় প্রবাহহীন, সময়ের তরল ভিজিয়ে দিয়েছে তার সব মাধ্যম। আমাদের বিজ্ঞানসূত্রময় পরিবেশ মজনু শাহের কাব্যকাননে তার ওজন হারায়।  বিকল্প-বিজ্ঞানের উপপাদ্য রচিত হতে থাকে। মানে দাঁড়ায় উপন্যাসিক কাব্যধারার, মানে এই সমকালীন কবিতা নন্দনের বিপরীতে, সময়ের পরিবর্তিত স্রোতের পক্ষে জেব্রামাস্টারের কবিতাগুলো আগুন ঝরাতে থাকে। তার তাপ মগজে অনুভূত হয়। আর বইটি সেই অগণন ড্রাগনমুখর পদ্মফুল যা বিকল্প আবিষ্কারের সত্যতা নিয়েই দাঁড়ালো পাঠকের সামনে। এই কবিতাগুলোকে অ-উপন্যাসিক বলা গেলো কেননা আমাদের অভ্যস্ত যুগান্তের ধারাবাহিকতার এক অপূর্ব ব্রেক। এই কাব্যের বেড়ে ওঠা ভিন্নতর। আসুন দেখি :

কোনো কোনো বিকেলবেলা, ইচ্ছে হয়, শয়তানের সঙ্গে বসে কফি
খাই। তার জীবনে কোনো প্রেম এসেছিল কিনা, আমার মতো তার
ঘুমের ভেতর দিয়েও সুড়ঙ্গ আছে কিনা- এসব জানার ইচ্ছে হয়।
কিন্তু মুশকিল হলো, যে কোনো বিকেলবেলাই চট করে ফুরিয়ে
আসে। আমি এইসব বিষণ্ণ রঙের সন্ধ্যায়, কাগজের তৈরি জোকারের
লম্বা টুপি পরে, ঝুমঝুমি হাতে, নূপুর পায়ে বেশ্যাবাড়ির পাশ দিয়ে
হেঁটে যাই। আর অকারণে মনে হতে থাকে, সব বেশ্যাবাড়িতেই
একটা করে পূর্ণবয়স্ক জামগাছ থাকা উচিত। প্রতিটি জামগাছের নিচে
এত অন্ধকার জমা হয় যে, তাকেই মনে হয় অভিভাবক! মহাব্যস্ত
শয়তানের সঙ্গে, রাতে, কফি নয়, পাকা পাকা জাম খেতে খেতে এই
মানবজন্ম কিম্বা অশ্বডিম্ব নিয়ে অনেক কথা বলার ইচ্ছে হয়। কিন্তু
মুশকিল হলো, চট করে রাতও ফুরিয়ে আসে। দিনে সাধারণত আমি
চালাই বুলডোজার, কেননা প্রত্যেক রাতেই অদৃশ্য কারা ইদানীং গড়ে
তুলছে খুলির পাহাড়...

একে আমরা কোন ধারাবাহিকতায় ফেলবো, মানে শয়তানের সাথে কফি খেতে না পেরে জাম খাওয়াখাওয়ি। এই বর্ণনা কোনো চিরসত্যের কাছে পৌঁছাতে চায় না। উপন্যাসধর্মের যে প্রকাশমানতার আশা সেই অর্থে এই কবিতা আশাহীন, মাত্র এপিক ন্যারেটিভ, সত্য বলে তাকে প্রতিষ্ঠিত হবার কোনো দায়ভার নেই। এই অর্থে বলা যায় ধারাবাহিক কবিতার তথ্যভাণ্ডারের বিপরীতে এই কবিতার নব ধারাকে  চিহ্নিত করা যায় ঈসথেটিকাল এন্ড হিসাবে। এইখান থেকে শুরু নয়া আলোকবর্ষের কবিতা।

ধূলি-মলিন গাড়ির কাচে কেউ একজন লিখে রেখে গেছে-
‘মাল্যবান’। পড়ে আমি চমকে উঠলাম। বিড়বিড় করে নিজেকে
বললাম: সময় নেই, সময় নেই, পা চালাও হাঁদা কোথাকার! সূর্যাস্তের
পূর্বে, বলির পাঁঠাকে পরাতে হবে রঙিন কাগজের মালা, আর
‘মাল্যবান, তুমি কোথায় লুকালে ভাই’ বলে চিৎকার করতে হবে
যেখানে দীর্ঘ প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে এখনো
যে-পথ যায়নি, সেই প্রেমের পথে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত একখানা ইতিহাস
বই হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন জল্লাদ, তার বাটারফ্লাই-মার্কা
গোঁফ দূর থেকে বোঝা যায়। এই নির্জনে, জল্লাদের চেয়ে বেশি
ভয়ের সম্ভবত ঐ অর্ধদগ্ধ ইতিহাসের বই, যা থেকে এখন খুলে
পড়ছে ‘ৎ’-গুলো। মাটিতে পড়ামাত্র স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠছে,
তারপর শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে ফিরে আসছে মাটিতে। আমাদের
পায়ে বেড়ি পরানোর জন্যে শিগগির হয়তো ঝরে পড়বে বিসর্গগুলো,
ঘটনার যুক্তিশৃঙ্খলা অন্তত সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আসলে কী বলতে চায় এই লিখিত উচ্চারণগুলো? আত্ম-ভুবনের মিহি মৌল স্বর শুনে মনে হয় আমরা হেঁটে পার হচ্ছি এমন এক এন্টি-বাস্তবতার দেশ যার প্রতিটি উপাদান অতি পরিচিত, তবে প্রকৃতপক্ষে তা ইঙ্গিতময় বিকল্পভাষায় প্রচারিত, প্রকাশিত। যেমন স্বপ্নের ভেতর গল্প বা দৃষ্টির সমন্বয়হীনতা আমরা মেনে নিই। এমনই এক নতুন জগতের আবিষ্কারক মজনু শাহ। পূর্ববর্তী কাব্যগ্রন্থগুলো থেকে এই কাব্যগ্রন্থে তিনি আরও বেশি স্বতন্ত্র আপন চরাচর নির্মাণে।

অনন্ত সময়ের মধ্যে একটি ঘড়ির ভূমিকা কী- এটা ভাবলে আমার
কিঞ্চিৎ মাথাব্যথা হয় বিকেলের দিকে। উপশমের জন্যে, তখন আমি
গাঁদাফুলে সাজানো নৌকায় গিয়ে বসি। এর মাঝি, প্রায়ই সহাস্যে
আমায় পাতাল-প্রবেশের প্রস্তাব দেয়। কিছুতেই আমি রাজি হই না,
কেননা পাতালে গিয়ে যদি দেখা যায়, সংখ্যায় পাতালও অনন্ত,
তখন?

এর চেয়ে সদা ভাসমান ঐ সমুদ্রগণিকার বাড়ি থেকে ঘুরে আসা
যাক। সময়, পাতাল ও দেহের তিনিই তো পরম শিক্ষক।

এই হলো মজনু শাহের কবিতা। তার কবিতাকে মাঝ থেকে কেটে কোট করা যায় না, কেননা অতিকথনের মেদভার এখানে নেই। সম্পূর্ণ কবিতাটাই নিজে নিজের পরিপূরক।
ছন্দ-ব্যাকরণ দিয়ে কবিতা লেখা হয় না। ছন্দ, সে কবিতার দেহের ভেতর রক্ত-উত্তাপ দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখে। ফলে, কবিতা তার নিজেরই প্রয়োজনে একে ধারণ করতে বাধ্য হয়। এবং এই ধারণের ধরন-সময়ে পরিবর্তন হয়। ফলে লাইট-ইয়ারের কবিতায় আমরা দেখতে পেলাম সফল অক্ষরবৃত্তের কারুকাজ। এই অক্ষরবৃত্তে রচিত হলো সফল উপন্যাসিক কবিতা। এবং জেব্রামাস্টারে এই অক্ষরবৃত্তেই রচিত হলো অ-উপন্যাসিক কবিতার নয়া নন্দন। বলা যায় অক্ষরবৃত্তের নতুন বিন্যাস মজনু শাহের জেব্রামাস্টার। সেই অর্থে এটা অক্ষরবৃত্তের দুর্ঘটনাই বটে। কেননা, আমাদের পঠিত অক্ষরবৃত্তের কবিতার সাথে তার কবিতার টেকচার যায়  না। কিছু ক্ষেত্রে তা বিকল্প পাঠেরও দাবি রাখে। সচেতন পাঠক তা দেখে থাকবেন। এটাকে প্রাপ্তির লাল নোটবুকে জমা রাখা যায়।
আসুন আরও কিছু কবিতা পাঠ করি :

১.
কোথায় সেসব, অজস্র গীতিকবিতা, মনুমেন্ট, জ্ঞানীমার্জার, অজস্র
ভ্রমরময় পত্র! মৌরসিপাট্টা হাত থেকে উধাও তাদের! অনিশ্চিত রঙ
নিয়ে খেলা করে একচক্ষু দানব, আজ, অন্য এক নিঃসঙ্গ দস্তয়েভস্কি
শুয়ে আছে খড়ে, চাপা কণ্ঠস্বরে, তার হিম উক্তি-
কিরিলভ! এখনো কি রাত্রি নেমে আসে চিন্তার ওপর!

অন্য এক সিসিফাস ফিরে যায় তার ব্যক্তিগত পাথরের দিকে। আমি
হিরামন পাখিটিকে ছেড়ে দেই, রাতের পর্দা ওঠে, বলি, মৃত্যুই
অতিথি, চিরন্তনতায় ছুটে যায় অহংপাখি-

বজ্রনির্দেশিত পথ খুলে যাচ্ছে পাপড়ির মতো, নাকি এও কোনো তত্ত্ব
অভিনয়! ঈগলের বাসা খুঁজে, জহরের দানা খেয়ে এ গহন আমিত্ব
ফুরায়।

গভীর সারেং আসে, পরিচয়পত্র কোথায় তোমার, বলে, জ্বলছে
শরবন, তাকে দেখ, খাগের কলম শুধু আনতে পেরেছি এবার, কত
শোকাকুল পৃষ্ঠা উড়ছে রাতের বাতাসে, তিতির পাখির রূপ ধরে
এসেছে শিষ্যেরা, মহাবালুকায় অ্যালার্মঘড়িটি পুঁতে রেখে অশেষ
ঘুমের কথা ভাবছে সমুদ্রপ্রেত-

আর তুমি কিনা দাঁড়িয়ে রয়েছ চিড়-ধরা দেয়ালের সামনে, কয়লা
হাতে, শরবনটিকে এখন ভাল্গার মনে হয়। সমস্ত কুসুম, ঘাস,
পাখি, পাখিব্রত, শিল্পপ্রহার, সবই কি ভাল্গার! মনে করো, বহু
রঙপেন্সিল হারিয়েছ তুমি ঘুমের ভেতর, একটি দুটি করে পারাবত
নেমেছে উঠোনে, যেন-বা ওদের মতো সুখ্যাতির ধুলোমাখা একটু
অন্ন আর কেলি প্রয়োজন, আর কিছু নয়, আমাদের অপরূপ জট খুলে
যাবে আয়নাব্যাখ্যায়, চন্দ্রবিন্দু-ঘেরা কোনো গল্পরাক্ষসের আসরে
মুক্ত হবে স্বর, সুর, আর ঐ রঙের দেবতা, যাকে অযথাই ভয়
পেয়েছিলে, ছদ্মকাঠুরে এক, এসেছে ছড়াতে আজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
নভোসংকেত, নীরবে।

২.
অস্তিত্বের রঙ কী- মাঝে মাঝে ভাবি। যেমন কোনো রাজমহিষীকে
দেখি নি কখনো, তবু তার মুখের রঙকাহিনি মনে পড়ে। ঐ হাবা
অরণ্যের পাশে, চুম্বকের বিছানাই আমার সব। রাত্রিবেলা, প্রান্তরে,
দেখা দেয় মহাজাগতিক ডিম। হারেমের রূপসীরা সেই দিকে
দৌড়াতে থাকে। সবাই রঙ পেয়েছে, রসিকতাও। কেবল এই বহু
ছিদ্রময় অস্তিত্ব¡, প্রতিমুহূর্তে অস্বীকার করে রঙ, আর সর্বত্র কায়েম
রাখে তার অট্টহাসি। সেদিন সাপরাজার সাথে দেখা, বৃত্তান্ত শুনে
বললেন, এইসব রেখে, কিছুকাল মেঘে মেঘে পায়চারি করুন-

৩.
একদিন, সরাইখানায় এক মাতালের অস্ফুট বাক্যস্রোত লক্ষ করে
চমকে উঠি, এ যে আমারই কণ্ঠ, অবিকল। চারপাশে, স্বরচিত
ভাবমূর্তির ফাঁদ। তখন ঘুমের প্রান্তে একটি শিশুজেব্রা গড়াতে গড়াতে
নিয়ে আসে অচেনা রঙের জম্বুরা। মনে পড়ে, এই রঙচিন্তা,
আধারচিন্তা আধেয়চিন্তার ফাঁদে আটকা পড়ে ধীরে ধীরে ভারসাম্য
হারিয়েছি। তোমার শূন্য মঞ্জিল, আর দূরের ঝাড়বাতির তলায় ঐ
কোলাহল- এর মাঝখানের পাহাড়ে আমি থাকি। তোমার উদ্দেশে
লেখা কিছু চির-অসমাপ্ত চিরকুট আজ ঝিনুকের খোলসের ভেতর
রেখে যাই-


১. সমুদ্র পাড়ি দেবার সময়, তোমার কথাগুলো হয়ে ওঠে
    মর্মর।
২. সারারাত বাঘের গন্ধ।
৩. .৯৯৯৯৯৯৯৯৯
৪. মেয়েদের কাশবন
৫. মার্কসিট দিয়ে বানানো রথ,
৬. যে পিয়ানো একা একা বাজে;
৭. স্পিরিচুয়াল ক্যালকুলাস, ঈশ্বর ও জবাফুল- এদের মধ্যে
   কাকে যে আমি বেশি ভালবাসি!
৮. আমার মনে এত বড় বড় ছিদ্র আছে যে...
৯. গঙ্গাফড়িং অশ্লীলতা বিষয়ে সবকিছু জানে।
১০. আমি কি পরিহাসলঘু?
১১. এই বই ও বাবুসমাজের বাইরে, একটা ড্রাগন তার পিঠে
     করে আমায় কোথাও উড়িয়ে নিতে চেয়েছিল।
১২. যৌন-জাহাজ।
১৩. পাহাড়ের শুরু ও শেষহীন ডায়েরি
১৪. ঘাসে ঢাকা মৃগইঞ্জিন এখনো বলে, ব্যথা লাগে...
১৫. লিচুগাছের নিচে তোমার ঊরু দেখার কথা ছিল না।
১৬. এই তবে ধ্যানমুগ্ধ সপ্তম বেড়াল ?
১৭. আমার মৃত্যুর তারিখের ওপর মেরুন রঙের একটা পাহাড়
      বসে আছে।

৪.
নগ্নবস্তু থেকে বস্তুনগ্নতায় পৌঁছবার পথে, মনে হতে পারে কারো,
কখনো কখনো কবিতাও তুচ্ছ

টেবিলে তখন অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি, ছিন্ন করবী-কুসুম ও প্রিজম।
ব্যাখ্যার আড়ালে, কবি তার শান্ত ক্রোধ নিয়ে ফিরে চলে ময়দানে,
ফেলে দেয় একটু একটু করে জমে-চলা রাত্রিমধু

সারাক্ষণ এক কুমকুমবর্ণ চক্রবাক তাকে ডাকে। পিপাসার নামান্তর
সেই পাখি। প্রহারের পর, সব রেখা, মন, রঙ মুছে গিয়ে শুধু এই।
বর্ডার লাইনে পৌঁছে গেছে, কাঁদছে, শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিয়ে
ফের রূপকাঙালের হাঁটা শুরু করে

অথচ কুটির ছিল, জলমধ্যে দেখা দিত জ্যোতির্বিম্ব মাঝে মাঝে,
জলপাইগাছতলে এক নিদ্রাযোগী, মনে পড়ে তার- ‘তত্ত্বতর্ক ভুলে
দেখ দেখি এইবার, কিম্বা, হরিণীর জন্যে বেড়ে ওঠা ঘাস যেন আমরা
না-ছুঁই কোনোদিন

নিষেধের সব চিরকুট ফেলে কবি হাঁটে আজ যূথভ্রষ্টা কুরঙ্গিণী পিছে,
আমাদের পড়াশুনা মৃদু থেকে মৃদুতর হয়, বাতাসের গায়ে ফুটে ওঠে
দু-একটি হর্ষলেখা

এদেরকে কি অক্ষরবৃত্ত বলা যাবে? আমাদের যে অক্ষরবৃত্তের পাঠ তার সাথে এই কবিতার প্রভেদ আছে ভাবে ও ভাষায়। মজনু শাহের এই আবিষ্কারকে কিছুকেই আস্বীকার করা যায় না। কেননা তার কবিতায় “অশ্রুর পরিবর্তে, যতিচিহ্ন বিসর্জনের প্রশ্ন উঠেছে।” শোনা যাক কবির স্বীকারোক্তি :

আমার ভাষা তৈরি হয় সেই নির্জনতায়, জেব্রা যেখানে তার
শাবকদের নিয়ে খেলা করে। বহু খুঁজে, পেয়েছি পেজমার্কার, একটি
উজ্জ্বল বিয়োগচিহ্ন আর ডালিমফুলের ছায়া। বন্ধ দেয়ালঘড়ির দিকে
তাকিয়ে, লিখতে শুর করি। একদিকে অসানোগ্রাফির ক্লাশ,
অন্যদিকে তোমার সঙ্গে সাঁতার কাটার ইচ্ছে। তাসের ঘরে এলেই
প্রশ্ন করো, আমি কি তুলোরাশির জাতক? ঘর অন্ধকার করে শুধাই,
তুমি কি কাননবালা? প্রশ্নেরা আজ হাসির কারাগার যেন। তোমার
শরীর থেকে তখন ঘাসের গন্ধ আসে। জানালা খুলে দেই অতঃপর
শান্ত হাতে। পাখিবাজার থেকে ফেরে লাঞ্ছিত লোকজন, নক্ষত্রের
আলো আসে আমাদের তাসের ঘরে।

নক্ষত্রের নীচে তাসের ঘরই তার নন্দনের ক্লাসঘর। এখান থেকেই তার শুরু। এই কাব্যগ্রন্থের পর গদ্যকবিতার দিকে নতুন করে তাকাতে হবে। পাঠককে বুঝে রাখতে হবে এর মাপ,পরিমিতি ও গঠনশৈলী। আর সেইরূপ মজনু শাহের জেব্রামাস্টার হিমায়িত সঙ্গীতের আর্কিটেকচার যা গদ্য-মাধ্যমে উদ্ভাসিত।
পাঠক আপনি পাঠ করুন এর বিকল্পস্বর।