বার্গম্যান, আপনি
অনুবাদ /গ্রন্থনা /ভাষ্য : পরিমল ভট্টাচার্য
প্রকাশক : অবভাস
       গড়িয়া স্টেশন রোড, কলকাতা-৮৪

"সম্প্রতি বার্গম্যানের মৃত্যুর পর বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে, ইন্টারনেটে, ব্লগ সাইটে সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাঁর অসংখ্য ভক্ত দর্শকের জবানিতে উঠে এল বিস্মৃতির বালিচাপা আবেগ। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, সিরিয়াস সিনেমার মতো এমন একটা কুলীন ও আত্মসচেতন শিল্পমাধ্যমে এত দেশ-কাল নির্ভর উপাদান নিয়ে এত ব্যক্তিগত স্তরে কাজ করে একজন শিল্পী এতকাল ধরে এত বিভিন্ন মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছেন, কাঁপিয়ে দিয়েছেন, ধ্বসিয়ে দিয়েছেন এবং, যেটা তাঁর সারা জীবনের অভীষ্ট ছিল- ছুঁয়েছেন তাদের বুকের ধুকপুকি।"

'বার্গম্যান, আপনি' বইটি আক্ষরিক অর্থেই ছুঁয়ে ফেলবে পাঠকের বুকের ধুকপুকি, বুক খুঁড়ে তুলে আনবে সেই বালিচাপা আবেগ যা যে কোনও মহান সৃষ্টির পরে পুঞ্জীভূত আনন্দ বা বেদনার মতোই ঝরে পড়তে চায়। ইঙ্গমার বার্গম্যানের চিত্রনাট্য, সাক্ষাৎকার, দিনলিপি, বক্তৃতার অনুলিপি ও আত্মজীবনী থেকে বেশ কিছু টুকরো টুকরো লেখার অনুবাদ এবং সেইসঙ্গে চমৎকার গ্রন্থনা ও ভাষ্য রচনা করেছেন পরিমল ভট্টাচার্য, আর তার সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে আমরা পেয়ে যাই বার্গম্যানের কিছু বিশ্ববন্দিত ছবির স্টিল ফোটোগ্রাফ।


"আমি নিজেকে কখনও একজন কারিগরের বেশি কিছু ভাবিনি, একজন অসম্ভব দক্ষ কারিগর...যে এমন কিছু চেয়ারটেবিল বানায় যা মানুষের কাজে লাগে।"- বার্গম্যানের এই অকপট স্বীকারোক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লেখক তুলে ধরেছেন অত্যন্ত জরুরি একটি প্রশ্ন- "বার্গম্যান এমন কী রেখে গিয়েছেন যা আমরা কাজে লাগাতে পারি?" এবং এই প্রশ্নের হাত ধরেই শুরু হয় এক ম্যাজিক্যাল জার্নি, যা অবধারিতভাবে আমাদের টেনে নিয়ে যায় "কড়া রোদে পোড়া পৃথিবী" থেকে একেবারে আচমকা এক অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের ভেতরে।

"ছায়াচ্ছন্ন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ক্যারাভ্যান চলছে, ভেতরে যাত্রীদের পরনে কালো জোব্বা, ততোধিক কালো গাছের গুঁড়ি, ঘন পাতায় ঢাকা আকাশ।" তার মধ্যে আমরা একে অপরের হাত খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি, অপেক্ষা করি, কখন "টর্চ-দাদা" এসে বুঝিয়ে দেবে আমাদের নির্ধারিত আসন। "ততক্ষণ আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব প্রেক্ষাগৃহের প্রান্তে, পশ্চিম দুনিয়ার শিল্প সাহিত্যের উপান্তে, যতক্ষণ না টর্চ-দাদা এসে আলো ধরে আমাদের পথ দেখান। কিন্তু টর্চ-দাদার বসন্তের আলো, পর্দার ভেতর থেকে নেমে এসে সারি সারি মুগ্ধ মুখগুলোকে মুড়ে দেবে সূক্ষ্ম রুপোলি তবকে। সেই অনির্বচনীয়, অন্ধের স্পর্শের মতো আলোর হাত ধরতে পারলেই আমরা ঠিক সীট খুঁজে পাব।" সেই আলোর হাত ধরে যখন একটু একটু করে ঢুকে পড়ছি আমরা, বাবা-মায়ের অন্তরঙ্গ দেহস্পর্শ চকিতে দেখে ফেলার মতোই চরম অস্বস্তিকর, দমবন্ধ টানেলের মধ্যে, আমাদের স্মৃতিকে তছনছ করে ভেসে ওঠে "পর্দাজোড়া মুখ, সাদাকালো, মুখের ক্লোজ-আপ, নির্দয় আলোর নীচে তিরতির করে কাঁপতে থাকা চামড়ার ভাঁজ, ঠোঁটের কুঞ্চন, চোখের মণি। সে মুখ লিভ উলম্যানের, বিবি অ্যান্ডারসনের, ম্যাক্স ভন সিডোর অথবা ইনগ্রিড থুলিনের। মানুষের মুখ। মানুষ।

সেই মানুষ, যে সম্পূর্ণ উদোম হয়ে থাকে ক্যামেরার সামনে, তার মুখ আর শরীর নিয়ে, তার যাবতীয় সীমাবদ্ধতা আর অভিব্যক্তির খামতি নিয়ে, বার্গম্যানের ছবিতে সেই মানুষটিই যখন সরাসরি তাকায় ক্যামেরা পেরিয়ে অন্ধকারে বসে থাকা আমাদের দিকে- "পর্দার আলোছায়া থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে চাহনিটা, সপাটে ঘুষির মতো, ঠিক যেমন অভিনীত চরিত্রের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মানুষটা, আর অনর্গল সেঁধিয়ে যেতে থাকে আমাদের ভেতরে। আমরা সেই ধ্বস্ত, অসুখী, ভিত, প্রেমার্ত মানুষগুলোকে ভেতরে বয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসি প্রেক্ষাগৃহ থেকে।"

ডায়েরির ছেঁড়া ছেঁড়া অংশগুলো পড়ে আমরা জানতে পেরেছি ইতিমধ্যে, সবসময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন বার্গম্যান। শুধুমাত্র ভাষাগত ব্যবধানের জন্য তারকোভস্কির অসম্ভব ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও দেখা করতে যাননি তাঁর সঙ্গে। আমরা জানতে পেরেছি স্টকহোমের মতো নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন একটা শহরে শীতকালের অপাবৃত অন্ধকারের ফাঁক দিয়ে জানুয়ারি মাসে ঢুকে পড়া ছোট্ট সুতোর মতো আলো, "যা বাড়তে বাড়তে ক্রমশঃ আমাদের বসন্তের দিকে নিয়ে চলে।" আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যখন বার্গম্যান বলছেন, "আমি ঈশ্বর ও যিশুকে ঘৃণা করতাম; বিশেষ করে যিশুকে, ওর অসহ্য কণ্ঠস্বর, প্যাচপেচে কমিউনিয়ন আর রক্তের জন্য।" আমাদের আস্তিকতার ভিত অব্দি নড়ে ওঠে, 'দি সেভেন্থ সিল' ছবির পাপস্বীকার কক্ষে দাঁড়িয়ে নাইট যখন বলছেন, "আমি কেন আমার নিজের ভেতরের ঈশ্বরকে হত্যা করতে পারি না? কেন তিনি আমার যন্ত্রণা আর হীনমন্যতার ভেতরে বাঁচেন?...আমি চাই ঈশ্বর তাঁর হাত বাড়িয়ে দিন, মুখ ফেরান, কথা বলুন আমার সঙ্গে।"

বার্গম্যানের ছবি, যতবারই দেখেছি, মনে হয়েছে মৃত্যু-আক্রান্ত। যে মৃত্যু সশরীরে এসে দাবা খেলে, প্রতারণা করে, তামাশা দেখায়। 'দ‌ি ম্যাজিক লানটার্ন' বইতে বার্গম্যান লিখেছেন, "মৃত্যু হল এক দুর্জ্ঞেয় আতঙ্ক- কারণ এই নয় যে ব্যথা লাগে, কারণ এটাই যে মৃত্যু হচ্ছে জান্তব সব স্বপ্নে ভরা, যার থেকে তুমি কোনওদিন জেগে উঠতে পারবে না।"

ছবির নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, "আমার ছবিতে ছন্দের গর্ভসঞ্চার হয় চিত্রনাট্যের ভেতর, লেখার টেবিলে, এবং তারপর সেটা জন্ম নেয় ক্যামেরার সামনে।...আমার কাছে ছবি তৈরি হল অনুপুঙ্খভাবে পরিকল্পিত একটি বিভ্রম। এতে প্রতিফলিত হয় বাস্তব, যা আমি যত বেশিদিন বাঁচছি ততই আমার মনে হচ্ছে বিভ্রমের মতো।"

স্বভাবপ্রেরণা, ছবি তৈরির অবচেতন উৎসের মতোই জোর দিয়ে বলেছেন বার্গম্যান নির্মাণশৈলীর কথা। গুরুপাক তত্ত্বের কাঁথাজড়ানো আনাড়িপনার মাথায় গাঁট্টা মেরে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, "শিল্প সৃষ্টিতে মানুষ খুন করার থেকেও বড়ো অপরাধ হল একটা বাজে শট, একটা পানসে ডায়ালগ।"

আবার সাহিত্যিক হয়ে ওঠার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকা সত্ত্বেও বার্গম্যান রচিত নাটক, ছোট গল্প, আত্মজীবনী, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ডায়েরি, চিঠিপত্র ইত্যাদির আশ্চর্য সজীব ভাষা, সুচারু চিত্রকল্প, কবিতার মতো সংলাপ আমাদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। একদিকে সাহিত্য, অন্যদিকে থিয়েটার- এই দুয়ের মাঝখানে চলচ্চিত্রের সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তিনি এবং জাদুকরের মতোই বিস্ময়াহত দর্শকদের সামনে তুলে ধরছেন একটার পর একটা বিভ্রম। আর সবকিছুর শেষে, মহান স্রষ্টার মতোই তাঁর উপলব্ধি-

"ছবি তৈরি আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ। খিদেতেষ্টার মতোই এটা আমার চালিকা শক্তি। কেউ বই লিখে নিজেকে প্রকাশ করে, কেউ ছবি এঁকে, কেউ পাহাড়ে চড়ে, কেউ নিজের সন্তানকে পিটিয়ে কিম্বা সাম্বা নেচে। আমি নিজেকে প্রকাশ করি ছবি বানিয়ে।"