হাতে আঁকা ঈশ্বরের ছবি / নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
স্কেচ ১
মুখে টুপি চাপা, ঘুমিয়ে রয়েছে শিকারী
পাশে বন্দুক শোয়ানো
আমি দেখি আজ শিকারেরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরছে
হাতে হাতে ধরা জলের বোতল, কাগজের প্লেটে মাংস
পৃথিবী হালকা টলছে
মুখে টুপি চাপা, ঘুমিয়ে রয়েছে শিকারী
পাশে বন্দুক শোয়ানো
স্কেচ ২
একদিন তুমি হঠাৎ নেমেছ
ছোট্ট একটা স্টেশনে
নাম জানবার প্রয়োজন মনে করোনি
আর যা-ই হোক ডাউন ট্রেন তো লক্ষ্যের দিকে
ফিরবেই
নিজেই নিজের পায়ের শব্দে বিহ্বল হয়ে ভাবছ-
এত খেলা আছে আমার দু'পায়ে! এত প্রাণ, এত শিল্প!
রাঙামাটি আর নুড়ি-কাঁকরেরা তোমার সঙ্গে গাইছে
একদিন তুমি হঠাৎ নেমেছ ছোট্ট
স্কেচ ৩
তুমুল বৃষ্টি
সারা কলকাতা শেডের তলায় দাঁড়িয়ে
ব্যস্ত চায়ের কেটলি
শস্তা ও দামী সুগন্ধী ঘ্রাণ, সিগারেট, স্বেদগন্ধ
ছাট বাড়তেই ঘেঁষাঘেঁষি করে মিশে যায়
শুধু একপাল কালো শিশুদের সঙ্গে ভিজতে ভিজতে
ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে চলে যান ঈশ্বর
তোমার ডান হাতে জরুরি ফাইল, বাঁ হাতে সময়
উদগ্রীব...
এত কাছ থেকে দেখেও চিনতে পারোনি!
স্কেচ ৪
ত্রিপল টাঙানো ভাতের হোটেল তোমাকে বসতে বলছে
থালারা বলছে- বিড়াল ডিঙোনো ভাত খাও
দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে আবার বের করে নিয়ে ভাবছ-
আরও এক ভাঁড় চা মেরে দিলেই খিদে-টিদে সব জব্দ
কাঁপা কাঁপা হাতে এভাবেই রোজ টুকরে টুকরে
স্বপ্ন
জড়ো করে ভিড় ট্রেন ঠেলে ফিরে যাচ্ছ
নিয়তি তোমাকে হারাতেই পারছে না!
স্কেচ ৫
যারা ফিরে যেতে চেয়েছিল, তবু কোথাও ফিরতে
পারেনি
তাদের স্বপ্ন পুরনো চালের প্রতিভায় ভাতে বাড়ছে
কার কত বিঘা ধানজমি, কার বাগানে হাজারি নারকেল
এসব গল্প ফিরে ফিরে আসে কাহিনীর উপকণ্ঠে
জেলে-কলোনির উঠোনে তখন শীর্ণ আঙুল উদগ্রীব
ধূসর কাঁথায় ফুটিয়ে তুলছে রঙিন স্মৃতির সম্ভার
মায়ের হাতের গয়নাবড়ির দুর্লভ সব নকশায়
অন্তবিহীন ইচ্ছের লতা উন্মুখ
বেশি কাছে বলে চাঁদ যেরকম তারাদের থেকে উজ্জ্বল
স্কেচ ৬
তোমাকে আঁকড়ে ডুবেছিল কেউ একদিন
সেইদিন থেকে ভিজে আছ খুব, স্বাভাবিক হতে পারোনি
জলের ধর্মে প্রতিটি সকাল গড়িয়ে চলেছে সন্ধেয়
তুমিও বঁড়শি ঠুকরিয়ে ফেরা রক্তমাখানো ওষ্ঠে
ছুঁইয়েছ বিষ, অনুচ্চারিত আবেগের মতো ওষধি
আর ছায়াছায়া আধোলীন কিছু বিস্ময়
সাটার নামানো দোকানের পাশে নিশ্চুপ সব রাত্রে
মিশে গেছে ঘুমে- যেভাবে হাতের গুণ মিশে যায়
রান্নায়...
তোমার-আমার নিজস্ব মাটি ফুঁপিয়ে উঠেছে কান্নায়!
স্কেচ ৭
চেয়েছিলে; তবু সাবধান হতে পারোনি
কিছুই করার থাকে না স্বয়ং উন্মাদ এসে ওড়ালে
স্নায়ুতে নিহিত শঙ্খের বুকে সমুদ্র যদি গর্জায়
সৈকতে বসে তোমার দুহাত বালির প্রাসাদ গড়বেই
মরবে জেনেও জলে নেমে যাবে বিশ্বাস
দাঁতে-দাঁত চেপে ঢেউ সামলেছ, এতটুকু প্রাণ
থাকতে
কিছুতেই হাত ছাড়োনি
চেয়েছিলে; তবু সাবধান হতে পারোনি
স্কেচ ৮
দুইচোখ যার সংকেতময়, আশরীর মহাবিশ্ব
তুমি তার দিকে প্রবৃত্ত হয়ে রয়েছ
কীভাবে সুযোগ হাতছাড়া হয় কখনও বুঝতে পারোনি
হেঁটে গেছ আর গাছের পাতায় ঋতুবদলের উচ্ছ্বাস
চারিয়ে গিয়েছে তোমার রক্তে লোহিতের মতো একদিন
মুমূর্ষু কোনও পথিক যখন খুঁড়ে খুঁড়ে জল খুঁজছে
তার বেঁচে থাকবার ইচ্ছেয় মিশিয়ে দিয়েছ আশ্বাস
অথচ তোমার তৃষ্ণার কোনও বিকল্প খুঁজে পাওনি
এই যে নিজের নিয়তির পাশে সাজিয়ে রাখছ নির্জন
কেউ কেউ একে মুত্যু বলছে, কেউ বা বলছে উদ্ধার
In : গুচ্ছ-কবিতা