কোলোম্বো বিমানবন্দরে বসেছিলুম, মুম্বাই ফেরার প্লেন ধরার জন্য। বিমানবন্দরের লাউঞ্জে ইনটারনেট সুবিধা ছিল বলে ভাবলুম দেখা যাক আমার ইনবক্সে কাদের চিঠিপত্র জমা পড়েছে। কিন্তু গুগল খোলা গেল না । লেখা এল যে তুমি যে প্রকৃতই তুমি তার প্রমাণ দেবার জন্য কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও--- বুঝলুম, যখন অ্যাকাউন্ট খুলেছিলুম তখন যে কথাগুলো লিখেছিলুম তা ভুলে মেরে দিয়েছি। ফেসবুকও খুলল না, আমার আঠারোশ 'ফ্রেন্ডদের' মধ্যে কয়েকজনের ফোটো দেখিয়ে চিনতে বলা হল--- পারলুম না। অগত্যা ভাবলুম বাংলা সাইট দেখা যাক--তাও সম্ভবপর হল না, কেননা বাংলা ফন্ট নেই কমপিউটারে। বসলুম গিয়ে সোফায়, যেখানে আমার স্ত্রী বসেছিল। ওর পাশের যুবকটি একাগ্রে নিজের 'ট্যাবলেট' কমপিউটারে পড়ছিল কিছু একটা, ভাষাটা চিনতে পারলুম না; তবে মনে হল কবিতা পড়ছে, কেননা সেভাবেই লেখাগুলো। জানতে চাইলুম, 'ওটা কোন ভাষা? কবিতা কি?' যুবকটি জানাল যে  ফিনল্যান্ডের ফিনিশ বা সুয়োমি ভাষা, এবং ও কবিতার আলোচনা পড়ছে, কবির নাম তুলসীদাস। ফিনিশ ভাষায় তুলসীদাস? জানতে চাইলুম, রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোরের নাম শুনেছেন? যুবকটি জানাল যে ওনার সম্পর্কে ইনটারনেটে ফিনিশ ভাষায় তথ্য আছে, কবিতাও আছে। জানতে চাইলুম, অন্য কোনো বাঙালি কবি? যুবকটি জানাল যে অন্য কারোর কবিতা বা তাঁর কবিতার আলোচনা পড়েনি।

কোলোম্বো থেকে ফিরেছি বেশ কয়েক মাস আগে। ফিরে, নেট ঘাঁটাঘাঁটি করে মনে হল যে বাঙালি কবিদের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কবিদের উপস্হিতি, অন্য ভাষায় কেন, বাংলাতেও নেই ! রবীন্দ্রনাথ আছেন প্রায় সব ভাষাতেই। এমনকী ফিজি দ্বীপের হিন্দিতেও লেখা রয়েছে, "এক বেংগলি পোয়েট রাহা উন টাইম পে জব কি ইনডিয়া ডিভাইডেড নাই রাহা। উসকে নাম পাহিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাহা। উ এক ফিলোজফার অওর অর্টিস্ট রাহা। উ ঢের বুক আওর ড্রামা লিখিস রাহা। উ মিউজিক আওর গানা ভি কমপোজ করিস রাহা।" জীবনানন্দ ভারতের ভাষাগুলোতেও অনুপস্হিত। আমার হিন্দিভাষী জনৈক পাঠককে দিয়ে জীবনানন্দ সম্পর্কে একটা পৃষ্ঠা উইকিতে খুলিয়েছিলুম, কিন্তু উইকির সম্পাদকমশায়রা নিজেদের জ্ঞান-মেশিনে 'দাশ' পদবিকে করে দিয়েছেন 'দাস'। অন্য বাঙালি কবিরা হিন্দিতেও নেই--- কেননা যে বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকেন এবং স্হানীয় ভাষা জানেন, তাঁদের আগ্রহ থাকলেও বইপত্র সম্ভবত নাগালে নেই। যাঁরা বিদেশে বসে বাংলায় ওয়েব-পত্রিকা চালান, তাঁরা কমার্শিয়াল খোঁয়াড় থেকে বেরোতে পারেননি--- ফিনিশ ভাষায় যদি তুলসীদাস-এর আলোচনা পড়া যায়, তাহলে অন্যান্য ভাষায়, অন্তত ভারতীয় ভাষায়, কৃত্তিবাস, ভারতচন্দ্র পড়ার সুযোগ থাকা দরকার। প্রশ্ন হল কে বা কারা করবেন সে-সব কাজগুলো? আমাদেরই করতে হবে। বাংলাদেশীরা তো করছেন; বাংলাদেশের কবিদের ছাড়াও তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের কবি-লেখকদের রচনাকে স্হান দিচ্ছেন। এমনকী রবীন্দ্রনাথের আগের বা উপেক্ষিত প্রাচীন কবি-লেখকদেরও আনছেন তাঁরা।

মিতুল দত্ত একটি ওয়েব-পত্রিকা বের করতে চলেছেন শুনে তাই ভালো লাগল। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ওয়েব-পত্রিকা আছে, তার পাঠক সংখ্যাও আগ্রহ জাগায়। পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকার বহুকাল কমপিউটার ঢুকতে দেননি; তাঁদের ভয় ছিল যে কমপিউটার ঢুকলে কেরানিরা কী করবেন ? মূলত কেরানি আর স্কুল টিচারদের নিয়েই ছিল বাঙালির বামচিন্তা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে সরকারি মসনদে যিনিই বসুন না কেন, কমপিউটারটাকে জরুরি মনে করেছেন, আর তাতে বাংলা ফন্টের যে কত দরকার তাও তাঁরা পশ্চিমবঙ্গীয়দের কানমুচড়ে দেখিয়েছেন। সেখানে কমপিউটারের দানব কারোর চাকরি খেয়ে দিয়েছে বলে তো শুনিনি। কমপিউটারে বাংলা ফন্ট জরুরি করায় বাংলাদেশে বহু বাংলা সাইটও নিজেদের স্হান করে নিয়েছে। সে-সব সাইটে যিনি চাইছেন তিনিই খাতা খুলে কবিতা-গল্প-নাটক-প্রবন্ধ লিখছেন; অন্যের রচনায় খোলাখুলি মন্তব্য দিচ্ছেন, যে-ধরনের মন্তব্য ছাপা-পত্রিকায় বড়ো একটা দেখা যায় না। সম্ভবত নানা সাইটের কারণে বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা কমে গেছে; তরুণ কবি-লেখকরা যে-যার নিজের ব্লগে লেখালিখি করছেন। এর ফলে যে লিটল ম্যাগাজিন বাংলাদেশে প্রকাশিত হয় তার মান  প্রশংসাযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গে তরুণ লেখকদের কাছে তেমন ধরনের মঞ্চ নেই, তাই তাঁদের কাছে লিটল ম্যাগাজিন বের করা আর তাতে নিজেদের লেখা প্রকাশ করা ছাড়া অন্য উপায় নেই; লিটল ম্যাগাজিনের এলাকাটা সেকারণে সাড়ে বত্রিশ ভাজার বাজার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশেও নিরীক্ষামূলক লেখালিখির ওয়েব-পত্রিকা হাতে গোনা। তাঁদের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের সবাইকে জায়গা করে দেয়াও সম্ভব নয়।  একটু আগেই বলেছি, বিদেশে কিছু ওয়েব পত্রিকা আছে যেখানে কেবল কমার্শিয়াল এলাকার লোকেদের আনাগোনা দেখি; মনে হয় তার জোগাড়েরা লেখালিখির জগতের বাইরে থাকেন বলে নিরীক্ষামূলক রচনার সঙ্গে পরিচিত নন। কিংবা নতুন ধরনের লেখালিখি পড়ে তাঁরা ঘাবড়ে যান। যাহোক, পশ্চিমবঙ্গে কমপিউটার ক্রমশ প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করছে, সঙ্গে বাংলা ফন্ট নিয়ে প্রবেশ করলে ভালো হয়। সাইবার কাফেগুলোতেও বাংলা ফন্টের ব্যবস্হা থাকা দরকার।

মিতুল দত্ত কী করতে চাইছেন জানি না। আমি চাইব যে তিনি কেবল এই সময়ের কবি-লেখকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন না তাঁর ওয়েব-পত্রিকা। মণীন্দ্র, মৃত্যুঞ্জয়, উত্তম ওনারা হাজার বছর, একশো বছরের কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছেন; ওয়েব-পত্রিকাতেও প্রাচীন বাংলা রচনার ও রচয়িতার সংক্ষিপ্ত জীবনীর এলাকা থাকা দরকার। দুটো কাজ হবে তার ফলে। প্রথমত, অনেকে, যাঁরা কখনও রবীন্দ্রনাথের আগের বাংলা লেখালিখির খবর রাখেন না, তাঁরা জানবেন। দ্বিতীয়ত, অন্য ভাষায় যাঁরা অনুবাদ করতে চাইবেন, বিশেষত যে বাঙালিরা বিদেশে থাকেন,তাঁরাও হাতের কাছে ম্যাটার পাবেন। ইনটারনেটের সুবিধা এই যে তা কারোর নিয়ন্ত্রণে নেই, এবং তা সারা পৃথিবীতে একটি ক্লিকেই ছড়িয়ে দেয়া যায়। মিতুলের এই ওয়েব পত্রিকার মাধ্যমে আমি বিদেশ-নিবাসী বাঙালীদের অনুরোধ করব যে তাঁরা স্হানীয় ভাষায় বাংলা সাহিত্যের কাজগুলোকে সেখানকার পাঠকদের সামনে তুলে ধরুন।