১৯৯০-এর বইমেলা। আমার কবিতার বই "তনুমধ্যা" বেরিয়েছে, আর ঈর্ষাভাজন বন্ধুদের তারিফে আমি তো সবে-আণ্ডা-পাড়া মুরগি। আমায় চুপসে দিল একটা বই : "এবাদতনামা"। রচয়িতা অপরিচিত কেউ নয়, তবে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক ব'লেই চিনতাম ("সুভাকুসুম দুই ফর্মা" ততোমধ্যে দেখে থাকা-সত্ত্বেও)।

তার পর জল যত গড়িয়েছে বুড়িগঙ্গায়, বইটার প্রতি ভালবাসা খুবএকটা না-কমলেও, এর বেলুন থেকে অনেকখানি গ্যাস উড়ে গেছে অ্যাদ্দিনে; যা প'ড়ে আছে, চমত্কার, কবিতা, কিন্তু ধ্যানবস্তু নয়; অধ্যয়ন, অধ্যাপন, জ্ঞাপন, কিন্তু উদ্বোধন, উদ্ভাসন নয়। যেন।

উনিশ বছর পর, এই ২০০৯ সালে, সৈয়দ তারিকের বই বার হ'ল : "মগ্ন তখন মোরাকাবায়"। আমার মনে হ'ল এখানে আছে কিছু, মোড়কের মধ্যে, তারিকেরই ভূমিকায় উদ্ধৃত সুফি সাধক জুনায়েদ বোগদাদির বাণীটির মতো : "এই জোব্বার ভিতরে আল্লাহ্ ছাড়া আর কিছু নেই।" বস্তুত অসীম দা (অসীমকুমার দাস) আর তারিকেরই কবিতায় আমি ক্ষুদ্র-আমির সঙ্গে বৃহত্-আমির সংগ্রাম আর রক্তক্ষরণ যেমন ক'রে দেখি, তেমন প্রকৃত বাউলদের পরে আর দেখা যায় না...

আমি বন্ধুদের নিয়ে লিখি না, তেমন। ভয়ে। একদিকে নেপটিজমের স্কাইলা, অন্যদিকে নেপটিজম-ভীতি-প্রসূত অবমূল্যায়নের ক্যারিবডিস। আর আমার বন্ধুরাও যা মাল একেকটা...

ও আমার লেখালিখি-সূত্রে, শাহবাগ-সখা নয়। সহপাঠী ছিলাম। পাল্লা দিয়ে হাইকু লিখতাম, ক্লাস পালাতাম, সারা শহর হেঁটে বেড়াতাম, বসন্তে-শরদে। আত্মহত্যার বাতিক ছিল, কত ঝক্কি। তাই, দরবেশ হয়েছে, চিল্লা করছে, মোরাকাবায় বসছে, জেনে বরং মন্দের ভালো ভেবেছি। অথচ নিরঙ্কুশ নাস্তিক ছিল, যদি থিয়লজি আর অকাল্টে উত্সাহের কমতি ছিল না।

সাত-বছর লেখে নি; আর তারপর এই একেবারে নব-উজ্জীবনের ভিতরেও আঁচ করা যায়, কম-বয়সের সুধীন্দ্র-প্রীতি আজও মোছে নি রক্ত থেকে...

আমি বলি না-- ফিরে আসুক। বলি না বিষ্ণুকেও, ফরিদকেও। কেননা কোথায় ফিরবে? আমি যেখানে ফিরে আছি? প্যারোল শেষে ফের সেই কারাগার? আলো তোমরা দেখেছ যারা, আমার বন্ধুরা, আমার মাগফেরাত কামনা করো।
 

"মগ্ন তখন মোরাকাবায়" থেকে

১.

আমি ছিলাম মগ্ন আঁধারের বস্তুপিণ্ড;
তুমি আমাকে তুলে আনলে আলোয়
আর সঞ্চার করলে প্রাণ :
প্রভু, তোমাকে প্রণাম।

আমি ছিলাম আমাতে লিপ্ত অহর্নিশ
অথচ আমার ছিলাম না আমি;
আমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছ তুমি :
প্রভু, তোমাকে প্রণাম।

চিরকাল আকুলতা ছিলো প্রেমের জন্য
অথচ কেটেছে সময় নিষ্করুণ অপ্রেমে;
প্রণয়ের যৌবরাজ্যে আজ আমার অভিষেক :
প্রভু, তোমাকে প্রণাম।



২.

অনিন্দ্য অষ্টাদশ বয়স যে তাঁর,
স্বচক্ষে দেখেছি তাঁকে আমি;
তদুপরি নারী তিনি, আরও যদি বলি :
আমি তারই স্বামী।

আমার মাতাও তিনি, আমার কন্যা,
সে আমার বোন;
শেরেকি এ পদাবলি অতিকথন না--
ওরে মূর্খ, শোন।



৩.

আগুন-দিগন্তে তুমি পরাক্রমে দেখা দিলে প্রভু,
বাঁশবনে বাতাসের বেগে;
সমস্ত নিসর্গ জপে তোমার বন্দনা অবিরল, আমি তবু
মগ্ন থাকি নিজস্ব আবেগে।

আমার আবেগও তুমি, আমার আমিও কিছু নয়
তুমি ছাড়া, এ কথা জেনেও
মেনে নিতে পারি কই? ওগো দয়াময়,
আমার সকল সীমা তোমার আদরে তুমি লুপ্ত ক'রে দিয়ো।