অনন্য রায়(৩০ নভেম্বর, ১৯৫৫ - ১৭ অক্টোবর, ১৯৯০) :  প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ছ'টি। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কাব্যবোদ্ধাদের মতে একটা সময়ে অনন্য রায় 'মাইকেলোচিত' একটি স্থায়ী ও উচ্চ অধিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত যে হবেন, তা শুধু সময়ের অপেক্ষা। এবং এই সিদ্ধান্ত বিদগ্ধ মহলে স্বীকুত- অনন্যর এই কাব্যনাট্য বা নাট্যকাব্যের 'ট্রিলোজি'(আমিষ রূপকথা, ১৯৭৯; চুল্লীর প্রহর, ১৯৮৩; আলোর অপেরা, ১৯৮৯)-টিই তার একমাত্র উদাহরণ।

 

অস্বিত্বের সংকট, অস্তি ও নাস্তির কূটাভাস(প্যারাডক্স), জীবন ও মৃত্যুর মধ্যেকার রহস্যময় দ্বন্দ্ব, সর্বোপরি, অব্যাখ্যাত নানা প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ ঔপনিষদিক প্রশ্নোত্তর ও তার ব্যাখ্যা- সব মিলিয়ে এই 'ত্রয়ী' কবিতার সাম্রাজ্যে এক চিরস্থায়ী স্তম্ভ। ঐতিহাসিক।

 

এক.

নিষ্পলক বসে থাকা : কফি ও টোস্টের বিবমিষা;
নীল কাপড়ের স্তূপ ছড়িয়ে পড়েছে এলোমেলো;
মেঘের মেখলাপরা বিষাদ-আরূঢ়া মোনালিসা
সহসা, দূরত্বমুগ্ধ, নিঃসঙ্গ আপেল কামড়ে খেলো;

সারাদিন সারারাত এই মৃত্যুযাপনের চিহ্ন আঁকাবাঁকা
নৈঃসঙ্গ্য উৎকীর্ণ করে উভয়ের শিলীভূত ভাস্কর্যভঙ্গিমা : ভাঙা সাঁকো;
নীল কাপড়ের স্তূপ মেঘ মোনালিসা এলোমেলো বেঁচে থাকা
স্তব্ধতা বুনন করে বিবাহের ভাঁজে-ভাঁজে ভস্মশেষ : নিস্ফল টোব্যাকো!



দুই.

তেজষ্ক্রিয় হাইড্র্যান্টে পড়ে থাকে নষ্ট দূরবীণ
পর্যুদস্ত স্বপ্নরশ্মি ইতস্তত স্মৃতিতে বিলীন
মৃত পালোমার মতো স্তব্ধ শ্বেত হিম নিঃসঙ্গতা
দাঁতালো হাওয়ার মধ্যে ওড়ে যেন উচ্ছ্রিত নির্মোক

হরিণের ধূম্রচোখে রেনবোচ্ছটা বর্ণাঢ্য রঙিন
বিচ্ছুরিত বিদ্যুতের মতো তবু সাতকোণা শূন্যতা
আকাশসমুদ্রে ঢেউয়ে মুহ্যমান নক্ষত্রপালক
গির্জার ঘন্টার ধ্বনি হয়ে জ্বলে শুধু রাত্রিদিন

যেন মৃত্যু; ভয়ার্ত আদরণীয় মরচে-পড়া নখ
বহুকৌণিক জ্যোৎস্নায় শিকারীর ব্যথা ও হরিণ
একাকার; হাইড্র্যান্টে বহুলাঙ্গ ইস্পাতের চোখ
জেগে দ্যাখে- সারারাত চাঁদের আহার স্যাকারিন!

গাছের মসৃণ ছায়া ঘাসে, যেন কফির চামচ।
ডিমের ভেতরে মুত্যু করে স্ফীত প্রজন্মের খোঁজ।।



তিন.

জলের প্রেমিক তুমি, চিংড়িমাছ, জলের অতলে নর্তকীর
মতো তুমি জাপানী ফ্লাওয়ার ভাসে চীনা মৃৎশিল্পে চিত্রার্পিত
দুটি শুঁড় কথা বলে জলগর্ভে শৃঙ্খলের সঙ্গে নিয়তির
অশ্রুত সংলাপ, তুমি এঞ্জিনের মৃত্যুশব্দে প্রলুব্ধ বিস্মিত।

জলের প্রেমিক তুমি, তবু যেন ঈডিপাস, জলের সন্তান, ঝিকিমিকি
কালের ঘন্টার মতো ঢেউয়ে-ঢেউয়ে অবিরাম নাচো এলোমেলো
যখন জালের মধ্যে ধৃত তুমি, অসহায়, একান্ত প্রতীকী
প্রতিশোধে মূঢ় আত্মহননে চুম্বনে যেন সশস্ত্র ওথেলো।।



চার.

স্বকন্যা-ধর্ষণ করে এ্যাতোকাল আমরা বেঁচেছি শব্দহীন
মেশিনের শব্দে শব্দে মৃগতৃষ্ণিকার শব্দে মেশিনের দ্যুতি
ফুটপাতে বা হাসপাতালে সমুদ্রের প্রস্তর-নক্ষত্র উতরোল।
রক্তকিংশুকের এই নারকী তীব্রতা ভালো নয়।

এর থেকে বীভৎস চীৎকারে ফেটে পড়ুক পৃথিবী
এর থেকে বীভৎস চীৎকারে ফেটে পড়ুক পৃথিবী
এর থেকে বীভৎস চীৎকারে ফেটে পড়ুক পৃথিবী...
হ্যাঁ, এই-ই সেই পৃথিবী যাকে মনে পড়ে- শুধু মনে পড়ে।



পাঁচ.

অন্ধ রাজা ঈডিপাস স্বপ্নচারী নক্ষত্রনিচোলে;
গ্রহের চুম্বনচিহ্ন, প্রত্নচূড়া, তাকে ছুঁয়ে যায়;
বিছানা, স্পর্শের ডানা, পৃথিবীর স্পৃহা শেষ হলে
উড়ে যায় সৌরকক্ষে- মেঘের উরসে- অজানায়

"কে নিক্ষেপ করে এই মাংসখণ্ড প্রথার বাস্তবে?
হে মেষপালক মৃত্যু, কেন ছুঁড়ে ফ্যালোনি আমাকে
অভ্যাসের ছেঁদো গর্তে- বশ্যতায়- নিহত বিপ্লবে
কাৎরে ওঠে মরা থীবস্- তেলেঙ্গানা- উত্তরণে ডাকে

(অস্তিত্ব : বিপ্লব!) তাই ডুবে যাবো চুল্লির পরাগে
বেজে উঠবে অর্থশাস্ত্র অর্কেস্ট্রার মতো অই স্তনাগ্রচূড়ায়
গর্ভকেশরের থেকে রেণু-রেণু ওষ্ঠরশ্মি জাগে
এবং চুমুক দ্যায় পেট্রলের- সৌরকক্ষে- দাহ্য পেয়ালায়

(অস্তিত্ব : বিদ্রোহ!) তাই 'হয়ে-ওঠা' উপলখণ্ডের
বিন্দু, হও নীল স্রোত; বাগীশ্বরী হও, হাতঘড়ি;
শিলীভূত হও, ধ্বনি; অন্ধ ঢেউ, হও প্রচণ্ডের
বর্ণমালা; স্বাদু ঘৃণা- গ্রন্থ- নরমাংসের প্রহরী!"

তখনই উদ্ধার দেখলো : রোদসীর আবৃত সংঘাতে
বাবার কবন্ধ লাশ- নুরেমবার্গ- পড়ে আছে পৌরপ্রতিভায়;
শুধু তারই ন্যাংটো বাচ্চা সেই চেরা-গ্রীবার ক্ষতে মুগ্ধ কচি হাতে
অঙ্গুলি প্রবিষ্ট করে, থকথকে রক্তের স্বাদ জিভে চাখে, অল্প হাসে,
                                                                     হাবা স্তব্ধতায়।।