গতকাল ফেসবুক না কোথায় দেখলাম একজন জানাচ্ছেন আজ জীবনানন্দের মৃত্যুদিন। হা, মনে ছিল না। তিনি, জীবনানন্দ দাশ, এমন একজন কবি, যার জন্মদিন-মৃত্যুদিনের কথা আলাদা করে মনে পড়লে পড়বে, না পড়লেই কী, তিনি তো এমনভাবে মনে ঢুকে বসে আছেন যে চাইলেও তাঁকে সে জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে পারব না। তবে মৃত্যুদিন শব্দটি এমন এক আবহ তৈরি করল যে, মনে এসে ভিড় জমাল তাঁর সম্পর্কে লেখা প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের কিছু উক্তি ও উদ্ধৃতি। তার মধ্যে ছিল এ অংশটি : একেবারে প্রথম বই 'ঝরা পালক'-এর দ্বিতীয় কবিতাটিতেই ছিল 'অগণন যাত্রিকের প্রাণ/খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান।'। আর শেষ যে-বইটির কবিতাগুলি নিজেই বিন্যস্ত করে গিয়েছিলেন তিনি, সেই 'বেলা অবেলা কালবেলা'র একেবারে শেষ কবিতায় আছে : 'কেন চলে যেতে চাও মিছে;/কোথাও পাবে না কিছু'। যেন একই সূচনাকথা আবার পৌঁছোল এসে শেষে, একইরকম এক না-এর দ্যোতনা নিয়ে। এই  প্রথম কবিতাটিতে মনে হয়েছিল, নগরী যেন কারাগার ধরণী ব্যাধবিদ্ধা (যে-শিকারের ছবি বারেবারেই ফিরে আসবে তাঁর কবিতায়), আর বাস্তবের এই রক্ততট থেকে মুক্তি পাবার জন্য সামনে আছে যেন কোনো মধ্যনিশীথের নীলিমা, নক্ষত্রের রাত। শেষ কবিতাতেও দেখি : মাথার ওপরে চাঁদ/চলছে কেবলই মেঘ কেটে পথ খুঁজে--'। কিন্তু তাদের কী হবে, 'মুখে রক্ত তুলে যারা খচ্চরের পিঠ থেকে পড়ে যায়?' কিংবা 'যারা শুধু বসে থেকে ব্যথা পায় মৃত্যুর গহ্বরে'?
এ বিষয়টি ছিল শঙ্খ ঘোষের প্রায় গবেষণারই মতো : জীবনানন্দের কবিতায় ‘না-এর দ্যোতনা’ খুঁজে ফেরা, (যা প্রসারিত হতে হতে ‘সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়—দ্বেষ’ পর্যন্ত পৌঁছেছে, এবং এই ভীষণ উপলব্ধিটি যে জীবনানন্দের, তা-ও আমরা অনেকেই জেনেছি, আমার ধারণায়, প্রথমবারের মতো, শঙ্খ ঘোষের সাক্ষ্যে)। ‘মতো’ বললে ভুল বলা হবে, গবেষণাই। এমন একটি বিষয়কেন্দ্রিক নিবিড় পাঠ থেকে আমরা পেয়েছি অনেক মণিমাণিক্য। তাঁর সূত্র ধরে আরও অনেক খুঁজে আনার চেষ্টা সম্ভব হলেও হতে পারে। আমরা ততদূর যাব না বর্তমান পরিসরে। তিনি যে-দুটি কবিতার কথা বলেছেন ওপরের লেখায় সে দুটি আমার ধারণা আমাদের অনেকেরই মনে নেই, কিন্তু শঙ্খের মন্তব্যপাঠের পর আবার পড়ার আগ্রহ অনেকেরই মনে জন্ম নেবে। সে কথা মনে করেই এবার কবিতা দুটি :

জীবনানন্দ দাশের দ্বিতীয় কবিতাবই ‘ঝরাপালক’-এর দ্বিতীয় কবিতা :

নীলিমা
       
রৌদ্র ঝিলমিল,
ঊষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারেবারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
        উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধুম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কঙ্করগুলি মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
        মরীচিকা-ঢাকা!
        অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার,—পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসকের কঠিন শৃঙ্খল,—
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল
তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন্‌ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
        বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
        স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
        মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখ মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
        বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি,—ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়,—স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
--শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!



শেষ কবিতাবই ‘বেলা অবেলা কালবেলা’-র শেষ কবিতা

হে হৃদ

হে হৃদয়,
নিস্তব্ধতা?
চারিদিকে মৃত সব অরণ্যেরা বুঝি?
মাথার ওপরে চাঁদ
চলছে কেবলি মেঘ কেটে পথ খুঁজে—

পেঁচার পাখায়
জোনাকির গায়ে
ঘাসের ওপরে কী যে শিশিরের মতো ধূসরতা
দীপ্ত হয় না কিছু?
ধ্বনিও হয় না আর?

হলুদ দু ঠ্যাং তুলে নেচে রোগা শালিখের মতো যেন কথা
ব’লে চলে তবুও জীবন :
বয়স তোমার কত? চল্লিশ বছর হ’ল?
প্রণয়ের পালা ঢের এল গেল—
হ’ল না মিলন?
পর্বতের পথে পথে রৌদ্রে রক্তে অক্লান্ত সফরে
খচ্চরের পিঠে কারা চড়ে?
পতঞ্জলি এসে বলে দেবে
প্রভেদ কী যারা শুধু ব’সে থেকে থেকে ব্যথা পায় মৃত্যুর গহ্বরে
মুখে রক্ত তুলে যারা খচ্চরের পিঠ থেকে প’ড়ে যায়?

মৃত সব অরণ্যেরা ;
আমার এ জীবনের মৃত অরণ্যেরা বুঝি বলে :
কেন যাও পৃথিবীর রৌদ্র কোলাহলে
নিখিল বিষের ভোক্তা নীলকণ্ঠ আকাশের নিচে
কেন চ’লে যেতে চাও মিছে ;
কোথাও পাবে না কিছু ;
মৃত্যুই অনন্ত শান্তি হয়ে
অন্তহীন অন্ধকারে আছে
লীন সব অরণ্যের কাছে।

আমি তবু বলি :
এখনো যে ক’টা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি,
দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস
সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর
নিষ্পেষিত মনুষ্যতার
আঁধারের থেকে আনে কী ক’রে যে মহানীলাকাশ,
ভাবা যাক—ভাবা যাক—
ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ ক’রে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত শত
শত জলঝর্নার খনি।