কখনো দিন শেষে ব্যর্থতার নক্ষত্র গুনে গুনে পুরো রাত্রি পুরো দিন নিষ্ফলা কাটিয়ে দিয়েছেন কোনো কবি, একটি কবিতা লিখবেন বলে। দু’চার লাইন লিখেছেন, কেটেছেন, আবার শেষমেশ পুরোটাই কেটেকুটে সে যাত্রা ক্ষান্ত হয়েছেন। আবার কখনো কখনো অপ্রত্যাশিতভাবে দিনে একাধিক কবিতা লিখে নিজের সৃষ্টির প্রতি অভিভূত হয়েছেন কতবার। এই অভিভূত হওয়ার ব্যাপারটা তাৎক্ষণিক। এতটুকু অভিভূত হতে না পারলে, শিল্পের সৃষ্টি স্তব্ধ হয় নিশ্চিত। কোনো শিল্প বা কবিতায় যথার্থ পরিণতজ্ঞানে সাফল্যসুখ জোটে না। কোনো চিত্রই তুলির শেষ আঁচড় থেকে নিষ্কৃতি পায় না। যদিও শিল্পীর নিজের সৃষ্টিতে স্থায়ী অভিভূত হওয়ার ব্যাপারটা বিরল। যে সৃষ্টি তাৎক্ষণিক ভাবে তার স্রষ্টাকে অভিভূত করে, সময়ান্তরে তা শিল্পীর জন্য অতৃপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এতটুকু অতৃপ্তি না থাকলে স্রষ্টার সৃষ্টির যাত্রাও বদ্ধ ছোট্ট জলাশয়ে আটকে পড়া জলজ প্রাণীর মতো। সুতরাং শিল্প সৃষ্টি করে তাৎক্ষণিক অভিভূত হওয়া এবং চূড়ান্ত বিচারে স্রষ্টার অতৃপ্তির ব্যাপারটি একই সৃষ্টির বেলায় সত্য।

কিন্তু যে সৃষ্টি সমাপ্ত হতে দেয় না, বারবার স্রষ্টার মনে উঁকিঝুঁকি আলোছায়া খেলে, কবিকে দু’চার লাইন লিখে আবার তা কেটে ফেলতে বাধ্য করে, আবার উঁকিঝুঁকি মেঘরৌদ্র খেলে, আবার তা বাতিল করে আবার লিখতে বাধ্য করে, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, তার ক্ষমতা বা অক্ষমতা কোথায়? ব্যাকরণগত সব দিক যদি রক্ষাও করতে হয়, সেটা রক্ষা করেও কেন কবি তাকে বার বার ছিঁড়ে ফেলেন, বাতিল করে দেন? সৃষ্টির শুরুতেই তিনি অভিভূত না হয়ে অতৃপ্ত থাকেন কেন? এর অনিবার্য কারণ, কবির নিজের সৃষ্টি তার স্রষ্টাকে সম্মোহিত করতে চুপিসাড়েই অক্ষমতা দেখিয়েছে। অর্থাৎ এই বারবার ছিঁড়েকেটে ফেলা পংক্তিগুলো কবি-হৃদয়কে সম্মোহন করে না। শরীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠার মতো কাব্যাংশে সম্মোহনী শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না।

দুই.

কবিতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা, ভাললাগা, সম্মোহন, আকর্ষণ, টান... আলাদা আলাদাভাবে বিবিধ কারণে সৃষ্টি হতে পারে। কিছু উদাহরণ কিংবা বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে তার কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরি। প্রথমত বর্তমান বাস্তবতায় দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বীয় স্বার্থে গণমাধ্যমের কিছু অসচেতনতা কিংবা পক্ষপাতমূলক কিংবা অজ্ঞতাহেতু ভূমিকা এই আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। কবিতার প্রতি এক ধরনের অদৃশ্য আকর্ষণ বা আগ্রহ সৃষ্টি করে। কবিতা না পাঠ করেই এ ধরনের আগ্রহ-আকর্ষণ পাঠক মনে সৃষ্টি হতে পারে। আবার অনেকক্ষেত্রে তোষামোদকারী কিংবা নুন খাওয়া বন্ধুরাও এমন কাজটি করে থাকতে পারে। যা কবিতার প্রতি অবমূল্যায়ন কিংবা কবির প্রতি অবিচার ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তাতে নানা কারণেই এ কবিতার অসংখ্য সংকলন মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তা আদৌ পঠিত হবে কিনা, এবং তার সুদূরপ্রসারী ফল কতটুকু, তা ভেবে দেখবার বিষয়। প্রশ্ন, গণমাধ্যমের এ-জাতীয় ভূমিকা কী স্বার্থে, কার স্বার্থে, এবং কতটুকু কবিতার স্বার্থে।

আবার প্রায় একই ধরনের মরীচিকাবৎ কারণে আর একটু ভিন্ন আঙ্গিকে কবিতার প্রতি এ ধরনের আগ্রহ-আকর্ষণ-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করা যায়। মনে থাকবার কথা : খুব সম্ভব গত শতকের মধ্য আশির দশকে সে সময়ের আলোচিত কবি টেড হিউজকে রাজকবি ঘোষণা করা হয়েছিল। তাতে আলোচনা-সমালোচনা যাই হোক না কেন, ঘোষণার পরপরই টেডের নির্বাচিত কবিতা সংকলনের হাজার হাজার কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। যদিও টেড হিউজের কাব্যশক্তি সম্পর্কে কবিতাপ্রেমীদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই, তথাপি তাঁকে রাজকবি ঘোষণার পর যে হারে বইয়ের কাটতি বেড়ে গেল, তা নিশ্চয় তাঁর কবিতার সম্মোহনী শক্তিকে ইঙ্গিত করে না, সন্দেহ নেই তা অন্য কিছুকে ইঙ্গিত করে। আবার সিলভিয়া প্লাথকে বিয়ে এবং পরবর্তীতে প্লাথের আত্মহত্যাও টেড হিউজকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিল যেমন, তেমনি তাঁর কবিতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টিতে প্রভাবান্বিত করেছিল।

আবার কবিতার কারণে, আবার কখনো কবির জীবনাচরণের কারণে কবির কবিতার প্রতি নানা ধরনের পাঠকের আগ্রহ-আকর্ষণ-সম্মোহন তৈরি হতে পারে। তৈরি হতে পারে ভালোলাগা, টান, পিপাসা। নির্মোহ বাঙালিপ্রেমিক ও বাংলা কবিতাপ্রেমিক ক্লিনটন বুথ সিলি মার্কিন মুলুকের মানুষ। পড়াশোনা করেছিলেন বিজ্ঞান নিয়ে। কবিতার প্রতি তাঁর কোনোই আকর্ষণ ছিল না, এবং তিনি কবিতার লোকও ছিলেন না। তিনি একবার মার্কিন পিস কোরের সদস্য হয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশের বরিশালে থাকেন। তখন তিনি বরিশালের কৃতি সন্তান জীবনানন্দের কথা শোনেন ও তাঁর কবিতার গল্প শুনে তিনি বাংলা শিখতে আরম্ভ করেন এবং একমাত্র জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ার জন্যই তিনি বাংলা পুরোপুরি নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসেন। অবশেষে জীবনানন্দের কবিতা তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করে দেয় যে, তিনি জীবনানন্দের জন্য একটি অসাধ্য সাধনের কাজ সমাপ্ত করেন, যা কোনো বাঙালি কিংবা ভারতীয়ও করতে পারেননি। ক্লিনটন বুথ সিলি জীবনানন্দের কবিতার প্রতি মুগ্ধ হয়ে ব্যক্তি জীবনানন্দের অন্বেষা শুরু করেন। এবং জীবনানন্দের পূর্বপুরুষ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে ‘আ পয়েট এপারট’ নামে জীবনানন্দের এক অসামান্য জীবনী রচনা করেন, যাকে এখনো পরযন্ত জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ বলে বিবেচনা করা হয়।

ক্লিনটন বুথ সিলির কবিতার প্রতি এই মুগ্ধতা কী কারণে তা নিশ্চয় আমাদের কাছে আর কোনো রহস্য তৈরি করে না। এ ক্ষেত্রে জীবনানন্দের কবিতাই যে বুথ সিলিকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছে, বিমোহিত করেছে, তা সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে।

আমার অনেক প্রিয় কবির মধ্যে তিনজনের কবিতাকে ঘিরে তিনটি স্মৃতির কথা মনে পড়ছে। সম্ভবত গত শতকের নব্বই-একানব্বই সালের কথা, আমার প্রিয় কবি সিকদার আমিনুল হকের ‘পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা’ বইটি কিনেছিলাম মাত্র দুই টাকায় পল্টনের কমিউনিস্ট পার্টির অফিসের সামনে থেকে। সেই প্রথম আমার তাঁর কবিতার সাথে পরিচয়, এবং সেই থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার প্রেম অমলিন আছে। কবির মৃত্যুতেও আমার সে প্রেম যৎসামান্য বাড়েনি বা কমেনি। সম্ভবত তাঁর সবগুলি গ্রন্থই আমার সংগ্রহে ছিল, এখনো বেশিরভাগই আছে মনে হয়। এখনো কবিতা পড়তে পড়তে ভাললাগার চড়ায় উঠলে, কিংবা খরায় পড়লে প্রায়শ আমার সিকদারের কবিতার বই হাতে উঠে আসে। তাঁর অকাল প্রয়াণের দুঃখ আমার দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। তখন তাঁর দু/চার পংক্তি অন্যের সংগে শেয়ার করে দুঃখ ভুলে থাকার ভান করি-

“স্থপতি ঐ মেয়েটির আগে থেকে আমার বাড়িটি
ভিখিরী হয়েছে দ্রুত- পরিধান তিনটি কামরা
বারান্দা ও বাগানের চেয়ে ছোট! তাই ব’লে ওকে
বলিনি ধ্যানের গল্প; ঘর থেকে আকাশের পথ
ক্রোশ-ক্রোশ বেশি দূরে! আমার কৈশোর চিরায়ত।
যদি তাকে বলতুম, বাড়ি নয়। কুটির বানাতো!”

                    ['নৈশ উৎস', পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা]

 
পরবর্তীতে ‘সতত ডানার মানুষ’, ‘সুপ্রভাত হে বারান্দা’ ইত্যাদি গ্রন্থে সিকদার আমার আরো প্রিয় কবি হয়ে ওঠেন।

কাছাকাছি সময়ের, সম্ভবত এর দুই এক বছর আগের কথা। আমার যৌবনের প্রারম্ভের দিনগুলো তখন কী উন্মাদনাময়। আর এক কবির কবিতা আমাকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল, মনকে মোমবাতিবৎ কোমল করে দিয়েছিল কখনো। তাঁর চিত্রকল্পের ব্যবহার ও কবিতায় তাঁর ছবি আঁকার ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। তিনি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

... “ভ্রমণে শয়নে তুমি সকল গ্রন্থের যুক্ত প্রণয়পিপাসা
চোখের বিশ্বাসে নারী, স্বেদে চুলে, নোখের ধুলোয়
প্রত্যেক অণুতে নারী, নারীর ভিতরে নারী, শূন্যতায় সহাস্য সুন্দরী,
তুমিই গায়ত্রী ভাঙা মনীষার উপহাস, তুমি যৌবনের
প্রত্যেক কবির নীরা, দুনিয়ার সব দাপাদাপি ক্রুদ্ধ লোভ
ভুল ও ঘুমের মধ্যে তোমার মাধুরী ছুঁয়ে নদীর তরঙ্গ

পাপীকে চুম্বন করো তুমি, তাই দ্বার খোলে স্বর্গের প্রহরী।”

                    ['প্রবাসের শেষে', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা]


এই রকম তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাজুড়ে অসংখ্য কবিতা পড়ে তাঁর কবিতার সম্মোহনী শক্তিতে আটকা পড়েছিলাম। সুনীল হয়ে উঠেছিলেন আমার সার্বক্ষণিক পাঠের কবি। এখনো তিনি তাই। মেস জীবনের রাত্রিগুলোয় নিজের চকিতে মশারি টাঙিয়ে, তার ভেতরে টেবিলল্যাম্পের আলোয় গভীর রাত জেগে তাঁর কবিতা পড়েছি। আজো বলতে চাই যে, এখনো ঠিক একইভাবে কবিতা লিখতে পারেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর সব কাব্যগ্রন্থ হয়তো পড়া হয়ে ওঠে না, কিন্তু যেখানে সেখানে খুঁজে পেলেই সুনীলের কবিতা পড়ি। তাঁর কবিতা আমাকে যে কারণে টানে, তা তাঁর শব্দ ও চিত্রকল্পের ব্যবহার, সাবলীলতা, ছবি আঁকার মুন্সীয়ানা, এ কথা আগে একবার বলেছি। এখন বলতে চাই যে, তাঁর কবিতার সকল সম্মোহনী শক্তি আমাকে স্পর্শ করেছে স্পর্ধায়।

ঠিক একই সময়ে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন আমার এ দুজনের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয় কবি। ঠিক একইভাবে পল্টনের ফুটপাথ থেকে কিনেছিলাম কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটি। তাঁর ঐ বইয়ের প্রথম কবিতাটিই আমার এ যাবত কালের সবচে’ প্রিয় কবিতার তালিকায় থেকে গেছে, হয়তো থাকবেই অনন্তকাল। কবিতার যে কী সম্মোহনী ক্ষমতা থাকতে পারে, আমার কাছে মনে হয় তা শক্তির এ গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘জরাসন্ধ’ পাঠ না করলে বোঝা যাবে না। মনে পড়ে কবিতাটি গত ২০/২১ বছরে অসংখ্যবার পড়েছি। প্রায় ৮/৯ বছর আর পড়া না হলেও এখনো প্রায় মুখস্থ আছে আমার পুরো কবিতাটি। কবিতাটি পাঠককে শুনিয়ে আরো একবার তৃপ্ত হতে চাই :

“আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।

যে-মুখ অন্ধকারের মতো শীতল, চোখ দুটি রিক্ত হ্রদের মতো কৃপণ করুণ, তাকে তোর মায়ের হাতে ছুঁয়ে ফিরিয়ে নিতে বলি। এ-মাঠ আর নয়, ধানের নাড়ায় বিঁধে কাতর হলো পা, সেবন্নে শাকের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।

পচা ধানের গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ, কৃপণ জলে তেচোকো মাছের আঁশগন্ধ সব আমার অন্ধকার অনুভবের ঘরে সারি-সারি তোর ভাঁড়ারের নুনমশলার পাত্র হল, মা। আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না, তখন তোর জরায় ভর ক’রে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি? আমি কখনো অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না।

কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র। তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস। অর্থ হয়, আমার যা কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র স’রে যাবে শীতল স’রে যাবে মৃত্যু সরে যাবে।

তবে হয়ত মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে। অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকবো, অন্ধকার হব।

আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।”


তিন.

কবিতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা, ভাললাগা, সম্মোহন, আকর্ষণ, টান... কী কী কারণে ঘটতে পারে তার কিছু উদাহরণ উপস্থাপিত হয়েছে নিশ্চয়। সঙ্গে গণমাধ্যম কেন্দ্রিক বর্তমান বাস্তবতাও বর্ণনা করতে চেয়েছি। কবিতার প্রতি পাঠক বিভিন্ন কারণে আকৃষ্ট হলেও, কবিতা কখনো তার অবস্থান পরিবর্তন করে না। কবিতা কবিতার মতো অটল পংক্তিতে দণ্ডায়মান। কোনো পাঠকের বা ক্রেতার পক্ষে কবিতা কথা বলে না। কবিতা তার প্রতি অবিচার সুবিচারের ধার ধারে না। তাই যে কোনো ভাষার শাশ্বত কবিতা সব সময়ের জন্য আধুনিক, সব সময়ের জন্য চিরকালীন। তাকে পরিবর্তন করতে গেলেই তার আবেদন আপেক্ষিক হতে বাধ্য।

মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে কবিতাকে আকর্ষণের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে গিয়ে তার প্রতি সুবিচার-অবিচারের ব্যাপারটি কখন কীভাবে ঘটে থাকে। আর এসব বিচার-অবিচারের দণ্ডে পড়ে কত উৎকৃষ্ট কবিতা দীর্ঘদিনই উপেক্ষিত হয়। আবার কোনো উৎকৃষ্ট কবিতা কোনো দিনই আলোর মুখ না দেখে তা চিরকালের অন্ধকার গর্ভে হারিয়ে যায়। সুতরাং আমরা যদি কবিতার প্রতি পাঠকের নানা কারণে আগ্রহ-আকর্ষণ করার পদ্ধতিগুলো উপেক্ষা করে, কবিতাকে পাঠ করে তার সম্মোহনী শক্তি দিয়ে তাকে মূল্যায়ন করি, তাহলে এ জাতীয় অবিচার করে কবিতাকে কখনো নির্যাতন বা প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ থাকবে না।

সুতরাং কী করে আমরা কবিতার এ সম্মোহনী শক্তিকে আবিষ্কার করবো তা উপরের উদাহরণগুলোতে স্পষ্ট হলেও এ নিবন্ধেই আরো বেশি স্পষ্ট করে তুলে ধরা যেতে পারে। এবং সেক্ষেত্রে উপরযুক্ত উদাহরণ ব্যবহার যুক্তিযুক্ত নির্দ্বিধায়।

নোবেল কিংবা কোনো বড় ধরনের পুরস্কারপ্রাপ্তি কিংবা রাজকবি ঘোষণা করে কবির কবিতার কাটতি বাড়ানোতে পাবলিশারদের নখ ফুলে কলাগাছ হলেও তাতে কবির আত্মতৃপ্ত হবার মতো কোনো কারণ থাকতে পারে না। কারণ হুজুগে পড়ে বিক্রি হওয়া কবিতা সেক্ষেত্রে তার প্রকৃত সম্মোহনী ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। একমাত্র কবিতা পাঠ ও পাঠাভিজ্ঞতা দিয়েই কবিতার সম্মোহনী শক্তিকে আবিষ্কার করা যায়। কোনো পুরস্কার বা ঘোষণা দিয়ে নয়। সে ক্ষেত্রে একথা নিশ্চিত ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সে সময়ের আলোচিত কবি টেড হিউজের যারা প্রকৃত পাঠক ছিলেন, তারা নিশ্চয় তাঁকে রাজকবি ঘোষণার পর তাঁর বই কেনার কাতারে হুমড়ি খেয়ে পড়েননি। হয়তো তারো বহু আগেই টেড হিউজের এসব গ্রন্থ ঐ পাঠক তাঁর কবিতার সম্মোহনী ক্ষমতার কারণেই ক্রয় করেছিলেন।

আবার ক্লিনটন বুথ সিলি যে জীবনানন্দ ও তাঁর কবিতার সম্মোহনী শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে শুধু তাঁর কবিতা পড়ার জন্য বাংলা শিখেছিলেন, এতেও কোনো সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে জীবনানন্দের অধিক সার্থকতা এখানে যে, তাঁর কবিতা যথার্থই তার সম্মোহনী ক্ষমতা বা শক্তি প্রদর্শন করে একজন বিদেশী পাঠককে পরযন্ত বশ মানিয়েছে।

অন্যত্র নিবন্ধের স্বার্থে আমার যে প্রিয় তিন কবির কথা এখানে উল্লেখ করেছি, এই তিন বাঙালি কবি কখনো নোবেল প্রাপ্তি বা রাজকবি ঘোষিত হবার মতো সুযোগের সান্নিধ্যে আসেননি। একমাত্র তাঁদের কবিতাই আমাকে তাঁদের চিরদিনের গুণমুগ্ধ পাঠক করে রেখেছে। কেবল তাঁদের কবিতার সম্মোহনী শক্তিই আমাকে আহ্লাদিত ও বিগলিত করেছে।

আবার আমার আর এক প্রিয় কবি, যিনি অনালোচিত, অপ্রচারিত, বা অপেক্ষাকৃত প্রচারবিমুখ থেকেই এখন দাঁড়িয়েছেন জীবনের শেষ প্রান্তে পঁচাশি ছুঁয়ে। তাঁর ‘মৌপোকাদের গ্রাম’ খুঁজে পেতে কতবার মৌমাছি হয়ে, নিভৃতে হুল ফুটিয়েছি কত কবিতাপ্রেমীকে। আর আজ তাই তিনি আমার সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম ভাললাগার কবি। তাঁর কবিতা অত বড় কোনো পুরস্কারে ভূষিত হয়নি। তাঁর কবিতা সাত ব্যাটারির টর্চের আলোয় ঝলসে ওঠেনি, কিংবা তাঁর কবিতা গণমাধ্যমের আনুকূল্য নিয়ে বুদ্ধিজীবীর চায়ের কাপে ঝড় তোলেনি; কিন্তু, তাঁর কবিতা আমাকে সম্মোহিত করেছে। তাঁর কবিতা ও জীবনযাপনের বাস্তবতা আমার কাছে তাঁকে প্রকৃত কবির মূল্যে টেনে এনে দাঁড় করায়। তাঁর প্রতি আমার অটল বিশ্বাস, শুধু কবিতার কারণেই তিনি আমার প্রিয় কবি। আমার মতো অনধিক সংখ্যক কবিতাপ্রেমীর প্রিয় কবি, আর তিনি কবি মণীন্দ্র গুপ্ত।

“কোথাও আরম্ভ নেই, শেষ নেই। তবু মানুষের দেশে ঢেউ
মানুষেরা কুলোর বাতাস নাড়িয়ে নাড়িয়ে তোলে। ফেউ
না ডাকলে রাতের চৌকিদার
রাতের স্রোতের মধ্যে মিশে যেতে পারে, এই ভয়ে
মানুষেরা বিকেলের নিস্তরঙ্গ আলোয় ভানতে ভানতে ধান,
বাঁশঝাড়ে সূর্য পাটে বসলেও, ঢেঁকিশালে পা ছড়িয়ে গায়
শিবের বিয়ের গান।
হায়! তুচ্ছ মাছিটিও সোনার মতন সনাতন মলে ও কমলে।
শুধু আমাদেরই,
শুধু আমাদেরই কৃতকর্ম নড়েচড়ে প্রতিবেশীদের নষ্ট জিভে।
ধেয়ে আসে
কুলোর বাতাস!”

           ['দেখা যায় না এপার ওপার', মণীন্দ্র গুপ্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃ-৩৭]

 

এইভাবে কবিতার সম্মোহনী শক্তিতে এখনো উজ্জীবিত কবি মণীন্দ্র গুপ্ত। চারিদিকের বজ্রভাঙা চিৎকার আর অসুস্থ নষ্ট প্রতিযোগিতায় কবিকে খুঁজে পাওয়া ভার। তিনি স্বীয় স্বর স্বীয় ভাব আবিষ্কারে মশগুল কবিতার সম্মোহনী ধ্যানে। তাই তিনি গ্রামের, শহরের, চিরকালের। তাই তিনি সম্মানের, 'অসম্মানের', নিভৃতের। আমরা যেন তাঁর এবং তাঁর মতো আরো অনেকের কবিতার সম্মোহনী ক্ষমতা আবিষ্কারে ভুল পথে পা না বাড়াই। আমরা যেন স্রোতের উজান ঠেলে কবির কবিতার সম্মোহনী শক্তিতে আকৃষ্ট হবার ভাষা খুঁজে পাই।