নভেম্বর '১১-র কবিতা

November 27, 2011

ভাসান

সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত

 

প্রতিবার প্রতিমা ভাসানো,

শিল্পীর মায়াবী শ্রম প্রতিবারই

সমবেত রেখে আসা নিষ্ঠুর নদীতে।

শিল্প মাটি হবে ফের, মাতৃগ্রীবা ঝরে যাবে জলের দাবীতে

বছরের পর বছর, এভাবেই বারবার

এই ধর্মদাস শিল্পের শুরু ও সংহার

মৃত্তিকাশিল্পীর অশ্রু ভাসানের সলিলে মেশানো।

 

তবু জড়ো হবে খড়, গড়ে উঠবে মানুষের নতুন প্রণতি

দেবীনয়ন এঁকেই মনে পড়ে যাবে

অন্য কোনও মর্ত-জননীকে,

মাতৃমানুষেরা দেবী চোখে চেয়েই থাকবে

তারপর নিজের চোখে ডেকে আনবে সমুদ্রের লোনা

যাবে দূর দূর দূরে, যে ভাবে বাতাস যায়

দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গী দশমীর নীল অবেলায়।

 

 

 

দুটি কবিতা

জহর সেন মজুমদার

 

বন্ধন

ভাঙা বাংলা, ভাঙা হ্যারিকেন

এই নাও শিব শক্তি কাম

অগ্নি আর জল সহ আমি

এইমাত্র গৃহে থামিলাম

ভাঙা বাংলা, ভাঙা হ্যারিকেন

এই নাও শিব শক্তি কাম

আমিও বৌদ্ধ বামাচারী

বন্ধন বিনাশ করিলাম

 

 

শ্রী ও শৃঙ্গার

এই নাও পাঁজরপঞ্জিকা, মৃদু মেঘ মৃদু আলো, অপরূপ শ্রী ও শৃঙ্গার

         ও সখা আর কেঁদোনা ও সখা আর কেঁদোনা

এই নাও স্বপ্নপথ, নীল নৌকা, ব্রহ্ম ও বালিকার ছয় ইন্দ্রিয়

         ও সখা আর কেঁদোনা ও সখা আর কেঁদোনা

এই নাও ভাঙা চাঁদ, ষড়রিপু, ভ্রমরসন্ন্যাস

         ও সখা আর কেঁদোনা ও সখা আর কেঁদোনা

এই নাও মেঘভর্তি কথা, মা ও প্রেমিকের শেষতম দারুচিনি দ্বীপ

         ও সখা আর কেঁদোনা ও সখা আর কেঁদোনা

                ও সখা আর কেঁদোনা ও সখা আর কেঁদোনা

 

 

 

তীথিক

অনুরাধা মহাপাত্র

 

আমাদের প্রার্থনায় আমরাই উত্তর দিই

তীথিকের তপঃশক্তি। অশরণ ত্রাণের স্বভাব

আমরাই বৃক্ষ আর নিজেকে জ্বালাই

আগুন, না ফাগ। বুঝি হেমন্তে চাঁদের অভাব

 

আমাদের যুদ্ধ আর অট্টহাস, শান্তি সন্ধান

সমস্ত নৌকো এসে ফিরে যায় উৎসে আবার -

লুপ্ত স্মৃতি। রক্তমাখা মেঘমালা। হাঁসের রন্ধন

ডেকে ডেকে দিগন্তে মিশে যায় করুণ আঁধার

 

যায় ফিরে তোমার হৃদয়বোধ - মায়াসভ্যতায়

বোধ থেকে বোধনে সংকল্প আর গানে বিসর্জন

দেখ, চিরউদাসী কুকুর একা পথের যাত্রায়

যাজ্ঞসেনীর একা দুঃখের আলোর তর্পণ

 

আজ লেখা রণভূমি, গান্ধারীর রুধিরাক্ত শোকে

কলকাতার পথে পথে কর্ণের নিয়তিই থাকে।

 

 

 

দাঁড়

সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

দাঁড়ের হিংস্রতা আছে-

আজ টের পাওয়া যায়

 

অনাক্রান্ত সাপের মতো সে নিরীহ নয়

বরং চিরুনিদাঁতের ধার

চুল উপড়ে নেওয়ার ছন্নতা

আছে দাঁড়ে ভর ক'রে

 

তবু তাকে দায় দিয়ে

শূন্যে পাড়ি দেয় কয়েক রমণী

শিস দেয়, গান তোলার চেষ্টা করে

সুরহীন ভঙ্গুর গলায়

 

লম্বা বারান্দায় দোলে লম্বাটে ও-দাঁড়

আমি দীর্ঘ জাফরির প্রান্তে এসে

উঁকি দিয়ে দেখতে পাই

তার বুকে বিছের মতন দাগ

দুই মুখে দু'দুটি কামড়

 

ভয় পেয়ে পালিয়ে যাই

চৌকোনা ঘরের মধ্যে

যা নিজেই আরও একটি দাঁড় হয়ে

আমার প্রাণের ওপর শিস দেয়, সংগীত বাজায়

আরও বিপুল ভয়ের

 

 

 

ভোরবেলা মৃতের উঠানে যে লোকগুলো জড়ো হয়েছিল তাদের নীরবতা, শোক ও আমার রহস্যবোধের ভেতর থাকা আলোকদীপ্তি কিংবা অন্ধকারের সীমানা

রায়হান রাইন

 

তখন আমার ভেতর লোকগুলো জীবন্ত, হাঁটছিল আমারই সঙ্গে। তারা একে একে বাইরে এলো, রাস্তায়। বাতাসের ফিনফিনে ঘোড়াগুলো ছুটছে। একটা বেত-ঝাড়ের পাশ দিয়ে আমি এক কাল্পনিক মানচিত্র ধরে হাঁটছি। ভোর সেই উঠানে শিশুদের কান্নার পাশে কিছুক্ষণ ঘুরতে থাকল, তারপর সরে গেল আরও খানিকটা দূরে।

 

তিলাবাজ উড়ছে একটা, ডোবার উপরে। তার ধাবমানতা যত স্পষ্ট, তার চেয়েও উজ্জ্বল একটা জানালা, জামির বনের ঘন ছায়ার পাশে, যেখানে একদা এক বুড়ো বসে থাকতেন। তার আত্মা আলোর পাঁজরে চেপে উঠে গেছে চতুর্থ আসমানে। সদ্যমৃত লোকটার অনুপস্থিতির পাশে থেমে আছে ছুটতে থাকা ঘোড়াগুলোর নীরবতা।

 

একটা কিছু, খুব অচেনা, থেকে থেকে জন্ম নিচ্ছে, জেগে উঠছে উঠানে দাঁড়ানো লোকগুলোর কথাবার্তার ফাঁকে, হঠাৎ-নামা নীরবতার ভেতর; একটা কিছু, জামির গাছের ঘন ছায়ায় মানুষের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ানো; একটা কিছু, আমার অহং-উঁচু গজদন্ত মিনারের মাথায় অচকিতে বসা, হাতে সূর্যের তরবারি, আর তার বিদ্যুৎ-ঝলকানি আমার হাড়ের ভেতর দিয়ে, রক্তমাংসমজ্জার ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ছে আত্মার বাগানে- আমি এক দুঃখের উচ্চতা থেকে দেখছি এইসব।

 

হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মানুষগুলোর ভেতর এসে পড়ি। আসতে আসতে দেখি, আমার সঙ্গে আমারই বয়সের ভেতর দিয়ে উড়ে চলেছে সেই তিলাবাজ। থেকে থেকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। কোথাও গাছের ডালে বসে নির্বিকার চোখে দেখছে হেঁটে-যেতে-থাকা আমাকে। কখনো চোখাচোখি হলে যেন তাকে দেখতে পাইনি এমন ভান করে অন্যদিকে তাকাই। ভিড়ের মানুষগুলোর মুখ দেখি- তাদের চোখের আলো পর্যন্ত সরে থাকে আমার ভয়।

 

 

 

আয়না

হিন্দোল ভট্টাচার্য

 

যত হিংস্র মনে হয়, তারও বেশি হিংস্র আমি আজ

কিন্তু ভয়ে কাঁটা হয়ে থেকে যাই, কী ভয় কী ভয়

বুক ধড়ফড় করে, নাড়ির গতিও দ্রুতগামী

রাস্তাঘাটে ধাক্কা মেরে চলে যায় দুর্গন্ধী ফড়িং

ঘৃণা থেকে ছিটকে বেওয়ারিশ পড়ে থাকে ভালোবাসা, -

আস্তাঁকুড়ে পড়ে থাকে সদ্যজাত শিশুর ছটফট;

মেহের আলির হাসি তখন আমার বর্ম, ঢাল!

হাহুতাশ হাওয়া চারিদিকে, আমি রাস্তা পার হই

চোখে চোখ রেখে দেখি কোথাও লেশমাত্র কিছু

হাত রাখার ঘর নেই... নেই কোনও উত্তরাধিকার

আমার যুদ্ধের ভাষা কালু ডোম পোড়াচ্ছেন ঘাটে

নিঃসঙ্গ বুদ্ধের চোখে, চণ্ডাল যখন নদী মেখে

হিংসার ভিতর থেকে তুলে নেয় চোখের জলটুকু!

আমার স্বভাবে নেই এমন উদাসী বসন্তের

মনখারাপ, আমি শুধু নিজেকেই আঁচড়ে ফেলে রোজ

আরও হিংস্র হয়ে যাই... আরও ঝড় মাথার ভিতর

দুর্বল, বোকার ঘুমে ছিঁড়ে ফেলে নিজের পোশাক।

ভালবাসা, তুমি আর কতদিন আমায় বাঁচাবে?

 

 

 

ম্যাজিক

অরুণাংশু ভট্টাচার্য

 

তোমার মায়ায় গোসাঞি স্থির নহে মন।

আমারে ত কহ গোসাঞি মায়ার খণ্ডন।।

                                     -শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

 

রাত্রি, পাঠাই ঘরে ঘরে

নিচু গল্প, জননী উদরে

 

ফোটে বৃক্ষ শব্দগন্ধময়

তার শিরোপরি চন্দ্রোদয় ;

 

সে-আলোর একটি মাত্র মানে

যিনি ভ্রূণ, তিনিই জানেন

 

জননীকে গল্প বলে চাঁদ,

হে রাত্রি, এ অপূর্ব সংবাদ

 

লিখে রাখো, পতনজনিত

যে-শব্দে সে গর্ভ খুলে দিত

 

প্রজাপতি তরে, অনুবাদ -

ভ্রূণে ভ্রূণে লেগে থাকে চাঁদ

 

 

 

রং

অনুপম মুখোপাধ্যায়

 

একটা সময় প্রতিটা কথার আলাদা রং হত

রেঙে থাকত লেখার টেবিল

রেঙে থাকত পাহাড়ের ভুল দিক...

 

পাহাড়ের নীচেই ছিল বাচ্চাদের স্কুল

সাদাকালো বাচ্চাগুলো ছুটে যেত রোজ

 

মোরগের ডাকও সাদাকালো হত

সাদাকালো কবরখানা...সাদাকালো রোদ...

 

আমরা পাথর দিয়ে মাপতাম পাথরের ঠাণ্ডা

মাপতাম একটা কথায় কত ছায়া পড়ে...

 

নানা রঙের ছায়া...

 

রোদ্দুর তো ভয় পেত মোমবাতিকে

 

আর আমরা পেপার ওয়েট তুলে তুলে খুঁজতাম

পাহাড়ের ঠিক দিকটা কোথায়...

 

 

 

ছুঁয়েছি ভাষা

অনির্বাণ পাল

 

হরিয়ালি গাছের আলোয় এঁকেছি হৃদয়

বসেছে প্রেম- গ্রাম্য বালিকার খোঁপায়

ছুঁয়েছি আল্লা, ছুঁয়েছি ঈশ্বর-

দু'চোখে মেখেছি পল্লীকথার গান

ভুলে যাই আজ অসুস্থ শহরের কথা

আমি আজ ছুটছি লালমাটির ঘোড়ায়-

টেরাকোটা শহরের গল্পে...

মৃদু চোখ আজ লন্ঠন আলোয় জ্বলছে ক্যামন করে

রাঙা পা দুলিয়ে নামতা পড়ছে-

                           সদ্য কিশোর ছেলেটি...

 

হরিয়ালি গাছের আলোয় ভেঙেছি বুক

ছুঁয়েছি কবিতাঘর-

তাই কবিতার অক্ষরে অক্ষরে বাজছে সরোদ-

                           গেয়ে উঠছে গ্রাম্য শব্দরা...

 

 

 

অনেক, অনেক দূর

পার্থপ্রতিম মজুমদার

 

অনেক, অনেক দূর বুঝি তাকে আজ যেতে হবে

জীবনের যত আলো সব যেন তাকে পেতে হবে

কীভাবে পাব যে তাকে, কোনওদিন পারব কি যেতে

হাওয়া শুধু হাওয়া বহে চিরকাল এই পৃথিবীতে

 

পাতার স্বভাব তার, চিরস্থায়ী থাকেনি কোথাও

দূরে উড়ে পুড়ে গেছে, উড়ে গেছে হালকা হাওয়ায়

কত কত জনপদ ঘুরে ঘুরে দেখেছে মানুষ

অবাক হয়েছে শুধু, বুক বেঁধে থেকেছে আশায়

 

হয়তো কখনও তাকে ঠিক বুঝি খুঁজে পাওয়া যাবে

সে যেন আলোর দেশ, অপরূপ সুরের ভুবন

যদি কাছে যেতে পারো পাবে সেই পরম পরশ

ধুয়ে মুছে যাবে যাও কালিমাখা অন্ধকার মন

 

অনেক দূরের পথ তবু সেখানেই হবে যেতে

জীবনের যত আলো সব যেন পেতে হবে তাকে...

 

 

অক্টোবর '১১-র কবিতা

October 11, 2011
তারায় পাওয়া
পিয়াস মজিদ

স্বপ্নের ভেতর কত জলাভূমি, দাহপথ।
বিজন স্বপনমহলে নিত্য আসা-যাওয়া
তবু পাইনি অগ্নি
      পাইনি ভেলা
খিড়কি আর সিংহদরোজায় দিনরাত বাঁধা থাকে
শুধু এক রক্তরথ।

এই উড়ন্ত নাও দিগ্বি...
Continue reading...
 

সেপ্টেম্বর '১১-এর কবিতা

September 16, 2011
মাছ 
সিদ্ধার্থ হক

মানুষ আহত হলে জলে নেমে মাছ হয়ে যায়
গম্ভীর জাহাজ এসে ঘরের ভিতরে ঢোকে, ভাসে, কথা বলে
জ্বর ও ঢেউএর ঘোরে বহুদূর থেকে নদী বারবার ডাক দেয় তাকে
খরস্রোত ব্যাস্ত হয়ে ওঠে চেতনায়
স্ব...

Continue reading...
 
blog comments powered by Disqus
blog comments powered by Disqus

Recent Posts