গীতাঞ্জলির গান / যশোধরা রায়চৌধুরী ও মিতুল দত্ত

October 11, 2011
আমার অগীত-অঞ্জলি    
যশোধরা রায়চৌধুরী

আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে
বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে ।
একলা বসে ঘরের কোণে কী যে ভাবি আপন মনে –
সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে ।।
হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল –
সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে ভিজে বনের ফুল ।
আঁধার রাতে প্রহরগুলি কোন সুরে আজ ভরিয়ে তুলি –
কোন ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে
বাঁধন হারা বৃষ্টি ধারা ঝরছে রয়ে রয়ে ।।
কিছুই অসুবিধে ছিল না। প্রথমেই এটাকে লেবেল করে দিতাম প্রকৃতি পর্যায়ের বর্ষার গান। আহাহা, কী সোঁদা গন্ধ উঠে আসছে না গানটা থেকে? খটখটে গ্রীষ্মের মধ্যে বসে, অথবা এ সি করা বহুতলের শীতল কক্ষে বসে, এই গানটা শুনলে বা পড়লে বেশ একটা বর্ষা বর্ষা ভাব আসে না প্রাণে? মনে হয় না বৃষ্টি ঝরছে, আর সেটা আপনি দেখতেও পান মানসচক্ষে?
কিন্তু ও সবে ভবি ভোলবার নয়। ও সব বহু হয়ে গেছে।  আমার পক্ষে সম্ভব না অত সহজে গদগদ হওয়া। সে হতে পারতাম ১৬ বছর বয়সে। এখন মনে প্রশ্ন জাগে। এই কবিতা/গানটা লেখার কোন প্রত্যক্ষ চার্জ আছে কি? একেবারে ভাবাই যায় না, এই কথাগুলো সত্যি সত্যি কোন সাক্ষাত অনুভবের রচনা। মানে, সত্যিই বৃষ্টিটা পড়ছে, আর কবি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন, আর ভাবছেন, লাইনগুলো মাথার মধ্যে আসছে। আচ্ছা, তখন কি কবি একা ছিলেন? ঠিক সেই রকম একা, যখন মানুশের আসে একটা বিভ্রান্তির মত আবেগের ভার। যে আবেগ কোথাও রাখা যায় না। কুরে কুরে খায় তাকে একটা অন্ধকার নীরবতা। প্রকৃতি, হ্যাঁ, প্রকৃতির সাহচর্য তখন মানুষের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে বৈকি। কবি তো লিখলেনও তাই : কী করব ভেবে পাই না, অন্ধকার রাতের ঘন্টাগুলি কীভাবে ভরাব। এটা তো যে কোন একা লোকের যা সমস্যা। বিশেষত যে লোক একটু বেশি সংবেদনশীল। তারপর আছে ভুলের কথা। সকল ভুলি। মানে কিছু একটা বোধহয় ঘটেছে। সেটা মনে করে রাখতে হবে। কিন্তু ভুল করে সেটা ভুলে যাচ্ছি। বৃষ্টি ভেজা বনের ফুলের গন্ধে প্রাণ কাঁদছে।
সিচুয়েশনটা যদি ভাবতে শুরু করি একবার,  শব্দের, সুন্দরের আড়াল সরিয়ে দিলে আমি যা পাই তা এক অদ্ভুত কাঁচা, দগদগে অনুভূতি। আর তখনই মনে হয়, এটা বর্ষার গান নয় একেবারেই। এটা একাকিত্বের গান।


আসলে রবি ঠাকুরের যে কোন গানকে বুঝতে আজকাল ভীষণ স্ট্রেন পড়ে। একেবারে সাংস্কৃতিক এক বিশাল ভজনপূজন, মুগ্ধতার ইতিহাস এসে সামনে দাঁড়ায়। একটা পলিটিকস এসে সামনে দাঁড়ায়। দায়ী কে? রবি ঠাকুর নিজেই ? তাঁর সর্বশায়িতা না কি যেন বলে? তাঁর রাজকীয়তা? নাকি ভাষার সৌন্দর্য ? ভাষার কাব্যকাব্য ভাবটা। যেটাকে আমরা রাবীন্দ্রিক বলি। আজকাল আর লিখি না।  ভীষণ হাসি পায়। অন্তত আমার। হৃদয়, কূল, সৌরভ।
আর হ্যাঁ, বৃষ্টি। সেই জিনিস, যাকে রবি ঠাকুর লিখে লিখে রস নিংড়ে একেবারে শূন্য করে ফেলেছেন। নাঃ। এই বর্ষার কবিতা আর গানের পেটেন্ট নিয়ে রবি ঠাকুর যে তহলকাটা মচালেন, তার ফলে যে পরবর্তী সমস্ত বাঙালি কবির বর্ষা, বৃষ্টি এসব নিয়ে যে কোন কবিতা লেখারই একেবারে দফা গয়া হয়ে গেল, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? আরে বাবা, একটা উপন্যাস একটা গল্প একটা কবিতা : কিছুতেই যে উনি আবার বর্ষার রেফারেন্স না দিয়ে থাকতে পারেন না। বাংলাদেশের কবি কুলদা রায় তাঁর একটা কবিতায় এই গোলমালটা নিয়ে লিখেছেন, একেবারে ঠিকঠাক লিখেছেন।

বৃষ্টি ঠাকুর

বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখব না। ঠাকুর লিখেছেন। বৃষ্টির চেয়েও বেশি। নিয়মিত জল ও পাতায়। ঠাকুরের পিতৃদেব জানে, বালিশের নিচে বৃষ্টিচিহ্ন রেখে দিলে বৃষ্টিফুল ফোটে। অথচ ঠাকুর একা একা ঘোরে। জলে। হাওয়ায়। অথবা দূর সমুদ্রের পিছে।
বৃষ্টি নেই। ভয়ে ভয়ে মৃণালিনী চেয়ে দেখে, বেলীর কণ্ঠ জুড়ে বেল ফুল ফোটে। বলে, যাই! রোদে রোদে কতদূর যেতে হবে মা।
তাহলে বৃষ্টি হোক। ঠাকুর ফিরুক ঘরে।

দুটো বৃষ্টিশাক তুলে আনি। বসো বাবা। ভুলে আনি দক্ষিণ ডিহি। দেখো, হাড়ির ভিতরে বৃষ্টি ফোটে। কবিতা জোটে না।

প্রতিটি বর্ষার কবিতা আমাদের এখন পুনরাবিষ্কার করে নিতে হয়। হ্যাঁ কাজটা চল্লিশের কবিদের করতে হয়েছিল, পঞ্চাশের কবিদের করতে হয়েছিল। আমাদেরও করতে হয়।

গীতাঞ্জলি নিয়ে লিখতেও আমার গায়ে ব্যথা করছিল শুরুতে। একশো বছর আগে একটা বই লেখা হয়েছিল, সেই বইটা নোবেল পুরস্কার পায়। এই তো ব্যাপার। এ বছরই, কেউ যদি পারত আরেকটা নোবেল আনতে, তবে না হয় হাততালি দিতাম। তবে প্রাইজ পেলেই যে কোন বই আমাকে খুব নাড়া দেবে সেটাও আর গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারিনা এখন। নাড়া দেওয়া , কথাটাই ধোঁয়াটে হয়ে গেছে কেমন যেন। আমাকে দেখান দেখি গীতাঞ্জলি প্যাটার্নের আর একটা এমন  স্পষ্ট কিছু... একেবারে নতুন যেন, একেবারে পরিষ্কার, দাঁড়িয়ে থাকা আলোর মধ্যে। আবার অন্ধকার? সেটাও আছে, যা আমাকে একেবারে আদিম এক বিন্দু থেকে নাড়া দেবে। যা একটা উদ্ভাসিত না কি বলে যেন সত্যের মত আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এখন তো সব কথার দুটো করে মানে, সব কাজের একাধিক তুলনামূলক অভিমুখ, সব ঘটনার অন্তত তিনদিক থেকে চারটে ভার্শান। তারাপদ রায় যেমন বলেছিলেন, আমার দিক, তোমার দিক আর তার দিক, এই তিনটে অন্তত ভার্শান তো থাকবেই সব কাহিনির। আর তা যদি না থাকে তাহলে তো কোনকিছুকে ভালো বলাও বারণ।
এইরকম সময়ে গীতাঞ্জলি আবার, ভার্শানহীন, দ্বিধাহীন, সম্পূর্ণ একটা জিনিস হয়ে থাকছে, এটাই তো একটা ব্যাপার যাতে বোঝা যায় জিনিশটা কতটা পুরনো, ডেটেড। তারপর আবার একেবারে অপরিচিত এবং কানেক্ট করতে না পারা আধ্যাত্মিক মাধ্যাত্মিক কী কী সব দর্শন যেন এটার সাথে জড়িয়ে আছে শুনতে পাই। ঈশ্বর, কিন্তু সেই ঈশ্বর না। যে ঈশ্বর বহুরূপে সম্মুখে তোমার। সেদিন টিভিটা খুলতেই দেখলাম, লাইভ অবশ্যই, ফোন ইনে এক বালকের সাক্ষাতকার। তোমার হিরো কে? উত্তরে ছেলেটি বলছিল, আমার ফেভারিট ক্যারেক্টার, ফেভারিট হিরো, ভগবান। কম্পেয়ারার মহিলা বলেন, ও মা, ভগবান, কী সুইট! কেন শুনি, কেন ভগবান তোমার পছন্দ? সে বলল, কারণ আমি রাম সীতাকে শ্রদ্ধা করি। কৃষ্ণকে শ্রদ্ধা করি। সাঁই বাবাকেও হেব্বি লাগে। ভগবান আমাদের কত ভাল করেন।
তো এখন তো সবাই ধার্মিক। যার যার মত করে ধার্মিক। বাবা লোকনাথ থেকে শুরু করে বাবা রামদেব, রবি শংকরজী। সকলের স্বাধীনতা আছে নিজের নিজের ফেভারিট ও হিরো ভগবান, নিজের নিজের মডেলের আধ্যাত্মিকতা বেছে নেবার। তাহলে রবি ঠাকুরের ফেভারিট ভগবানটা এদের মধ্যে কোনরকম? ওটা কি একটা আর্ট অফ লিভিং, একটা কাব্যজিজ্ঞাসা, না একটা ব্রাহ্ম আধ্যাত্মিকতা? জীবনদেবতার শিকড় নিয়ে টানাটানি করেছেন আমাদের বাংলা স্যারেরা, পৃথিবীর জন্ম আর মৃত্যু দুই স্তনের কন্সেপ্ট দুই হাত শূন্যে নেড়ে বুঝিয়েছেন যাঁরা, তাঁরাই। নোট লিখতে লিখতে একশো শতাংশ মেয়ে-ছাত্রের  বাংলা পাস ক্লাসে মুখ টিপে হেসে অস্থির হয়েছিলাম। শুনতেই ভুলে গেছিলাম কে ছিলেন এই জীবনদেবতা। যিনিই হোন,  তাকে নিয়েই কি গীতাঞ্জলির সব কবিতা লেখা? কে এত ঝামেলার মধ্যে ঢুকবে বাবা। পারা যাচ্ছে না।
রবি ঠাকুর এখন ক্লিশে। এক্কেবারে ঝরঝরে মাল। এইরকম অতিব্যবহৃত মরচে পড়া ঘিষাপিটা জিনিশ আর নেই। এই ঠাকুরটিকে আমরা শয়নে স্বপনে বসার ঘরে শোবার ঘরে সর্বত্র টাঙিয়ে রাখি, ছোটবেলায় পঁচিশে বৈশাখ পাড়ায় বেশ ফাংশন টাংশন হত, হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাচ্চা মেয়েরা মা মাসির শাড়ি দু ভাঁজ করে পরে, আর শান্তিনিকেতনি বাটিকের চাদর পাট করে বুকের উপরে আড়াআড়ি জড়িয়ে, নাচানাচি করত, ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে অথবা মম চিত্তে গানের সঙ্গে। তো, এগুলোই মূলত রবি ঠাকুর। ঢুলু ঢুলু চোখ, বৃন্দগান। মনে ফুরফুর। সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা  আর হাতে মোবাইল, গলায়কানে মোটা জাংক জুয়েলারি, আর চওড়াপাড় তাঁতের ডিজাইনার আঁকিবুকি কাটা শাড়ি ।
রবি ঠাকুর উপন্যাস টুপন্যাসও লিখেছিলেন বটে, তবে সেগুলো ভীষণ কঠিন। দাঁতে কাটা যায় না। আর আমরা কাটবই বা কেন? সেগুলোকে ঠিকঠাক প্যাকেজিং করে আমাদের পাতে ফেলার জন্য তো আছেনই এখনকার নাট্যকাররা, চলচ্চত্রপরিচালকরা। পিরিয়ড  ড্রামা, হাতে ফ্রিল দেওয়া ব্লাউজ, অথবা খালি গায়ে (কী ঝিলিক!) থান শাড়ি (লুকনো লুকনো সেপ্টিপিনে ঠিক ঠিক জায়গায় আটকানো, যাতে সরে না যায়)... এখনকার ডাকসাইটে পর্দানায়িকারা রবি ঠাকুরের ওই কঠিন কঠিন উপন্যাসের স্যান্ড পেপারের মতন খরখরে ব্যক্তিত্বময়ী কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রগুলোকে “ইন্টারপ্রেট” করে দেবেন।  দেখে টেখে চলে আসব। সত্যজিত  “ঘরে বাইরে”টা একদম পারেননি, সেটা তো  সেই থেকে জানি, বড় সমালোচকের লেখা থেকে। যদিও আমার আর সব ভাল লেগেছিল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অক্ষম চুমু ছাড়া। এখন আর ‘চোখের বালি’ বা ‘চতুরঙ্গ’ নিয়ে বেশি আলাপ আলোচনা করি কেন।  সেই সব সমালোচকেরা কোথায় যেন, কবে যেন উধাও হয়েছেন। এখন রবি ঠাকুরকে রি-ইন্টারপ্রেট করা একটা ইন থিং, প্রশংসার্হ ব্যাপার। একশো পঞ্চা বছর পরেও রবি ঠাকুর আমাদের অতিব্যবহৃত পাপো, ছাই ফেলার ভাঙা কুলো, আজকের জীবনের যত অ্যাংস্ট সব ভরে দেবার নধর বেলুন। রবি ঠাকুরের কথা অমৃত সমান। তিনি আছেনই । থাকবেনই। চিরভাস্বর না কী যেন বলে।
সুতরাং আমি আর অনধিকার চর্চা করি কেন! কিন্তু কোন যুক্তিই ধোঁপে টিঁকল না। লোকজন লিখছে। বিপুলভাবে লিখছে । আমাকেও লিখতে হবে। না লিখলে আমাকে পান্ডিত্যহীন ঠাউরে, সংবেদনহীন ঠাউরে লোকজন ছ্যা ছ্যা করুক আর কি। এত বড় একটা কর্মযজ্ঞ হচ্ছে জগতে, যাকে বলে আনন্দযজ্ঞ, আর আমার তাতে নিমন্ত্রণ পড়েছে। আর আমি তাতে পাট্টিছিপেট করছি না। উফ ভাবা যায় না।
একে তো রবি ঠাকুরের সার্দ্ধশতবর্ষ। সে এক খটমট বাংলা। তবু ১৫০ বছর বলা যাবে না। তাহলে অশিক্ষিত প্রমাণ হবে। মৃত্যুতে, জন্মে, বিবাহে, পৈতেতে, গাছ পোঁতায়, ফাংশনে, পুরস্কারে, তিরস্কারে, রাজদ্বারে, শ্মশানে, সর্বত্র গাওয়ার মত গান যে রবি ঠাকুর লিখে গেছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মত। না দ্বিতীয়জন গান লেখেন নি তবে সব ওকেশনের উপযুক্ত একটি করে কোটেশন ঝেড়ে গেছেন। সেগুলো যাতে সব বিষয়ের বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা যায়, সেই জন্য। ফিজিক্স, অংক , অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, মাইক্রোবায়োলজি, এথিক্স, ফিলজফি, ফিল্ম চর্চা, কোন বিষয় বাদ দেন নি।  রাশিয়ান পাব্লিকেশনের সব বইয়ের প্রথম পাতা খুললেই দেখতে পেতাম সেগুলো আমরা, সেই যুগে, যখন ভারত-রাশিয়া ভাই ভাই। বইগুলোও খুব চকচকে সস্তা সুন্দর ।
রবি ঠাকুরের গানও তেমনি। কোন অকেশন বাদ নেই। ভুল করে এবার আপনি যদি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে “সমুখে শান্তি পারাবার” গেয়ে ফেলেন, তাহলে পাপ দেবে না রবি ঠাকুর? অথবা বিয়ের দিন, আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা অথবা আজি এ আনন্দযজ্ঞে না গেয়ে,  গেয়ে ফেলেন, এসেছিলে তবু আসো নাই জানায়ে গেলে। লোকে অশিক্ষিত বলবে না? তো, গীতাঞ্জলি নিয়ে যা লিখতে যাব, তাতে তো একই ব্যাপার। এত গুরুগম্ভীর ব্যাপার। আকাশে চক্ষু তুলে দীর্ঘশ্বাস, মাঝে মাঝে একটু একটু বলতে হবে, আর কয়েক মুহূর্ত থামতে হবে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর মত। 


তাছাড়া আমার কাছে গীতাঞ্জলি কী, রবীন্দ্রনাথ কী, একথা আমি সবাইকে বলতেই বা যাব কেন? আমি বাবা ভাল মেয়ে, ইশকুলে সব সময়ে হাত দিয়ে খাতা ঢেকে রেখে লিখতাম প্রশ্নের উত্তর, ফিসফিস করে কেউ জিগ্যেস করলেও বলে দিতাম না ইতিহাসের তারিখ বা ভূগোলের বর্গমিটার। আমি যে এখন খেটেখুটে কবি, এটাও তো আর একটা পরীক্ষার পথ। রোজ রোজ় চ্যালেঞ্জ আসে নানা দিক থেকে। এটা তো আর ফাঁস করতে পারিনা, আমার কবিতার মূলে আছে একটি রাবীন্দ্রিক গদগদপনা... ছোট্টবেলা থেকে রবি ঠাকুর পড়ার উল্লাসময় দিনকাল! গোপন আস্তিনে যেরকম উত্তর লিখে আনা চিরকুট লুকনো থাকে, আমারও তো থাকে। সেই সকালবেলা গুলো।
সেই সকালবেলাগুলোতে আমি কখনো প্রেমের গান শুনে শিহরিত, কখনো পূজার গান শুনে কী যেন কী একটা পেয়ে গেছি। জানালায় দুলছে লতানে একটা গাছের সবুজ সবুজ চিকরি চিকরি পাতায় ভর্তি ডাল। ছোট ছোট টব।  তাদের নাম নয়নতারা? যে নামেই ডাকো, নিরীহ গাছগুলো এমনিই হয়, আপনিই ফোটে। কিন্তু মা তাদের জল দেয়। মা এক হাতে বালতি নিয়ে আর এক হাতে ছোট ট্র্যান্সিস্টর রেডিওটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে জল দেয়। জানালায় জানালায়। যখন শোবার ঘরে আসে তখন পৌণে আটটার রবীন্দ্রসংগীত শুরু হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠতে না চেয়ে কানের উপর বালিশ চাপা দিয়েছি, কিন্তু তাও শুনতে পাই পঙ্কজ মল্লিকের বিখ্যাত তাই তোমার আনন্দ আমার পর, তুমি তাই এসেছ নিচে। সুবিনয় রায়ের গলায় জগত জুড়ে উদার সুরে। রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি। একেকটা শুনি আর এক এক রকমের দৃশ্য ভাবি। কে সেই ব্যক্তি যিনি উপর থেকে নিচে নামেন? রূপসাগর তো ডেফিনিটলি কিছুদিন আগেকার বেড়াতে যাওয়া সেই দীঘার সমুদ্রের মত একটা সমুদ্র। তার থেকে কি পাওয়ার জন্য ডুবুরি নামানো হল? অরূপরতন ব্যাপারটা আমি বহুকাল বুঝিনি। আবার বুঝে দেখি ওটা রবি ঠাকুরের টোকা মাল। বাউলের কন্সেপ্ট। সে অনেক পরের কথা। বোঝা টোঝা চিরদিন খতরনাক। স্বপ্নভঙ্গকারক। না বোঝার আনন্দ পেতে পেতে ক্লাস ফোর ফাইভে ওই প্রশ্নগুলো জাগত মনে। শুনি কণিকা মুখোপাধ্যায়ের গলায় আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে। হয়ত বা জীবনে যত পূজা হল না সারা। শুনে একটা চার্জ পেলাম। উঠে পড়েছি। সকালটা অন্যরকম হয়ে গেছে। মা মাঝে মাঝে রেডিও নামিয়ে রেখে হয়ত রান্নাঘরে গেল । তবে মায়ের অভ্যেস হল সর্বত্র রেডিও নিয়ে ঘোরা, বসবার ঘর থেকে পড়ার ঘর, শোবার ঘর থেকে খাবার ঘর। এমনকি বাথরুমেও যেতে দেখেছি, শ্যাম্পু সাবান রাখার ধাপের উপরে রেখেছে রেডিও। আমিও কন্ডিশনড হতে থেকেছি রবীন্দ্রসঙ্গীতে। 
প্রথম যে “প্রেম কাকে বলে” বোঝার অভিজ্ঞতাটা, মানে অবশ্যই থিয়োরিতে। সেটাও ওই পৌনে আটটার গানেই। তুমি একটু কেবল বসতে দিও পাশে, আমায় শুধু খনেকতরে। এই গানটা শুনে দশ কি এগারো আমি, তার বেশি না, সর্ব অংগ শিহরিত না কী বলে যেন, হল আমার। বেশ বুঝতে পারলাম, মানুষের একটা ইমোশন অন্তত আমি পেয়ে গেছি। আমি এলেম তারি দ্বারে, ডাক দিলেম অন্ধকারে। শুনে কেঁপে গেছি। ওরকমই বয়স। বা এর একটু বেশি। ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা, হ্যা, এটা শুনে তখনো বিভ্রান্ত আমি, হুবহু প্রেমের গানের মত শুনতে, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা প্রেমের গান। অথচ গানটা পূজা পর্যায়ের। কী করে হয়? গীতাঞ্জলির ভেতরে তো এইসব গানগুলো আছে।  আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার? উন্মাদ, উন্মাদ প্রেম। এইরকম দু নম্বরী লোক আর একটাও হয়েছে? প্রেমের গানকে পূজার গান বলে চালিয়েছে? সুদূর কোন নদীর পারে/ গহন কোন বনের ধারে/ গভীর কোন অন্ধকারে/ হতেছ তুমি পার / পরানসখা বন্ধু হে আমার। বাপরে, এই জায়গাটায় আমি একটা সিনারি দেখতে পাই পরিষ্কার, চোখে। অন্ধকারের একটা স্বচ্ছ দৃশ্য। একজন একা মানুষের হেঁটে আসা। ইত্যাদি ইত্যাদি।
গীতাঞ্জলিতে জীবনে যত পূজা, বা সীমার মাঝে অসীম তুমি, এমন গানও বেশ কিছু আছে। আমার মাথা নত করে দাও হে, বা অন্তর মম বিকশিত কর। তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে। বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহার। পূজা পর্যায়ের সব গান তো আর প্রেম পর্যায়ের সাথে গুলিয়ে যায় না। বেশ স্পষ্ট করেই আলাদা থাকে। এগুলো সেই রকম। এগুলো সামাজিক । বিশ্বসাথে যোগে গাওয়ার, ভাবার, বেসুরো হবার অধিকার সব দেওয়া আছে এই গানগুলোয়। তার কারণও আছে আবার। ইশকুলের প্রেয়ারের গান এগুলো। হ্যাঁ, সবুজ ফিতের বিনুনি আর সাদা সবুজ স্কার্টে গাইতে হয়। সরুমোটা গলায়।
একটু একটু করে এইভাবে পেয়ে উঠি আমার রবি ঠাকুরকে। পরে ঝেড়ে ঝেড়ে কবিতা লিখব, তার সব মেটিরিয়াল। কিন্তু এগুলো ফাঁস করছি কেন? এগুলো আমার ট্রেড সিক্রেট। এগুলো কাউকে বলার না। বলা মানেই হেরে যাওয়া। নিজের অন্ধ সেই ছোটবয়সের সবচেয়ে দামি মুহূর্তগুলোকে ধুলোয় ছড়িয়ে দেওয়া।
কারণ তারপর তো, আমি বড় হয়ে গেছি। স্টিলের বলয়ে নিজেকে ঢেকেছি। ভান আর স্মার্টনেসের খপ্পরে পড়েছি। রপ্ত করেছি নাক কুঁচকে তাকানো ওইসবের দিকে। হ্যা হ্যা করে হাসা দেহাতীত, অশরীরী প্রেমের দিকে। এরকম প্রেম প্রেম করে হদ্দ হওয়া লোকটার সবকিছুই কি সত্যি  প্লেটোনিক, রবিবাবুর আলখাল্লার তলায় কী কী আছে তা নিয়ে সন্দেহ কৌতূহলের সঙ্গে।


কিন্তু সত্যি কি গীতাঞ্জলি সেই শুরুতে যা বললাম, স্পষ্ট কিছু... একেবারে নতুন যেন, একেবারে পরিষ্কার, দাঁড়িয়ে থাকা আলোর মধ্যে? না তারপরই তো এটাও বললাম, “আবার অন্ধকার? সেটাও আছে, যা আমাকে একেবারে আদিম এক বিন্দু থেকে নাড়া দেবে। আসলে কী বলতে চাইলাম, তাহলে ? আসলে রবি ঠাকুরের সম্বন্ধে যখন পড়ি, যে, একা একা তেতে ওঠা মাটির বাড়ি শ্যামলীতে বসে শান্তিনিকেতনের শুকনো রৌদ্রস্নাত দুপুরে তিনি লিখে চলতেন, বা সারারাত ধরে একটি গান রচনা করার সময় গাইতেন আর কাঁদতেন, কাঁদতেন উচ্চস্বরেই, যাতে সেদিনের অতিথিরাও শুনতে পেতেন সেই কান্নাবিজড়িত গান : তখন বুঝতে পারি, কোথাও একটা কিছু খুব বদলে গেছে, একেবারে বদলে গেছে। জাতীয়তাবাদী প্রজেক্টে দেশ জাতি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা যদি পালটে থাকে, নিজের প্রতি তাকানোর মন ও মনস্কতাও পালটে গেছে। শিল্পের সাথে পালটে গেছে শিল্পীর সম্পর্ক। না পালটালে আমরা কি বুঝতে পারতাম না একটি কবিতা লেখার সময়, একটি গান রচনার সময়ের ওই কষ্ট, যা একটি ধরার ছোঁয়ার মত বস্তু একেবারে, সম্পূর্ণ বাস্তব একটি বেদনা। সাধে কি আর কথায় কথায় ‘বেদনা, বেদনা...’ করে যেত লোকটা ! সেই বেদনাটা যদি না থাকে সেইরকমের লেখাটাও বোধহয় হয়না। আর এই যে বেদনার অন্তঃসার ঘেঁটে গেছে আমাদের, সেই তীব্রতায় কোন দহনই আর আসেনা, আর কোনকিছুই প্রতিভাত হয়না স্পষ্ট করে, তা-ই তো বলে দেয়, আমরা আমাদের সৃষ্টির প্রতি কতটা নন-কমিটাল, উদাসীন, হ্যাতক্যাতশূন্য, অনুভূতিরহিত। আসলে সৃষ্টির যে পথটা দ্বিধা আর সংশয়ে পূর্ণ, সেই কাদায় মাখা পথটা অমাবস্যার রাতে অতিক্রম করার অনিচ্ছে, জল-কাদা-কাঁটায় বিক্ষত হবার অনিচ্ছে আমাদের, আর তাই আলো পাওয়ার কোন প্রত্যাশাও নেই, কেননা হাই পাওয়ার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আমাদের তার থেকে বেশি আলো দেয় বলে ভেবে ফেলেছি; সেই সংশয় এবং অন্ধকার, বেদনা এবং শোক, লিখতে লিখতেই যে ওইসব লোকেদের আলোয় পৌঁছনো। আলো দিয়ে শুরু হয়না কোন কিছুই। অন্ধকার ছানতে ছানতেই যায় তারাও, এটা আমরা ভুলে গেছি। রবি ঠাকুর আলোর কবি, গীতাঞ্জলি আলোর কবিতা, এরকম ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আর তাই বোরিং মনে হয়, ক্লিশে মনে হয়, রি-ইন্টারপ্রেট করার দরকার পড়ে।
জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে/ জানি হে, জানি তাও হয়নি মিছে । - পিছে থেকে যাওয়া এত এত ভাব, গান, ঘটনা, আবেগ – সবের লটবহর নিয়ে টেনে টেনে চলার কথা কিন্তু রবি ঠাকুর এই প্রথমবার বললেন না।
আসলে আমার রবি ঠাকুর কিন্তু এই সব পথ চলা, এই সব লড়াই, টেনে টেনে চলা, ক্লান্তির কবি। আমার অন্ধকারের ভেতরে থাকা আত্মা রবি ঠাকুরের অন্ধকারকে চেটে খায়, তার ভেতরে ডোবে, আরাম পায়। আলোর কবি রবি ঠাকুর নয়, যে লেখে “আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে, যে লেখে “আমি এলেম তারি দ্বারে, ডাক দিলেম অন্ধকারে” সেই। তার বারংবার কান্না, সৃষ্টি, কান্না, হেরে যাওয়া, বার বার আত্মআবিষ্কার, আমি দেখি । 
আসলে রবি ঠাকুর আমার পার্সোনাল প্রপার্টি। সেই রবি ঠাকুরটাকে আমি কারুর সঙ্গে ভাগ করে নিতে রাজি নই। তাকে আমি সেভাবেই রেখে দেব। আমার নিজস্ব বেছে নেওয়ায়, রবিলেখার ওই অস্বাভাবিক বেশিত্বের ভেতরে ছোট্ট ছোট্ট দুটো বই। একটা ক্ষণিকা। আর একটা লিপিকা।  ক্ষণিকা বা লিপিকা গীতাঞ্জলির থেকে অনেক বড়। আমার কাছে।  কিন্তু এটা সিক্রেট। কাউকে বলবই না এটা ।





নিঠুর হে
মিতুল দত্ত

"আমার এ ধূপ না পোড়ালে, গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে
আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো।"...


আঘাতের ছদ্মবেশে এলে
আমাদের ত্রিতাপ শূন্যতা

হস্তীমূর্খ সেজে বসে আছি
যেন স্থিতি, যেন প্রবণতা

যেন এক সন্ধ্যার সারস
আমাদের ঘৃতকুমারীতে

রেখে গেছে হিমাঙ্ক-মর্মর
অতিচেতনার পৃথিবীতে

তবে এই দেহের দেওয়ালি
সাজাব কীসের সারাৎসারে

আলো হয়ে আছে যে নিঠুর
সেও যদি জ্বালাতে না পারে?

অসহ্য লাগত। কোনওদিন পছন্দ করতে পারিনি গানটা। সেও তো কম দিনের কথা নয়। সে ছিল আমার শৈশব। সাত-আট বছরের কচিবেলা। নতুন হারমোনিয়াম এল আমাদের বাড়িতে। চণ্ডীদার বাবা এল। মা-কে গান শেখাতে। ঠিক যখন আমরা খেতে বসতাম। ভরদুপুরবেলা। নিমের পাঁচন গেলার মুখ করে মা গান গাইতে বসত। তখনই শুনি গানটা। সেই প্রথম। এই করেছ ভালো নিঠুর হে’। নিঠুর’ কথাটার মানে জানার পর ওই লোকটাকেই মনে হত। নিষ্ঠুর। একটামাত্র ঘরে ভাড়া থাকতাম আমরা। সেই ঘরে আমাদের খাওয়ার পাশে বসে লোকটা পেপার পড়ত। মা কখনও বাটি করে আলুপোস- বাড়িয়ে দিত। কখনও মৌরলার টক। আমাদের ভাগ থেকে তুলে তুলে। লোকটা খেতে খেতে বাবার সঙ্গে বাজারদর আর গানবাজনার ভবিষ্যৎ নিয়ে এঁড়ে-তর্ক জুড়ত। আর অত ছোটবেলাতেও, এখনও আমার দিব্যি মনে পড়ে, হারানো মৌরলার শোক আর ভরদুপুরে প্যানপ্যানানি শোনার বিরক্তি মিলেমিশে ভেতরে-বাইরে কী যে জ্বালা ধরিয়ে দিত। মনে হত লোকটার গলা টিপে মেরে ফেলি। এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো।’

একদিন মা আর পারল না। রোববার ছিল সেদিন। মাংস হয়েছিল। বাবা আড়াইশোর বেশি মাংস আনত না বলে মা আমাদের মাংসটা দিয়ে নিজে হাড়গুলো খেত। আমাদের মুখের মাংস চণ্ডীদার বাবাকে দেবে না বলে মা একেবারে তাড়িয়েই দিল। বুড়ো মানুষটার মুখের ওপর বলে দিল, আর আপনাকে আসতে হবে না।” অন্ধকার মুখ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেল, মা-র গানের মাস্টারমশাই। একটা কথাও না বলে। সেদিন মনে হয়েছিল, তাহলে আমার মায়ের মধ্যেও আছে, সবার মধ্যেই থাকে নাকি লোকটা? ওই নিঠুর?

আরও খানিক বড় হয়ে, তখন আমি খেয়াল শিখি। কুমুদবাবু, কুমুদরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। রোববার করে গড়িয়াহাট নিয়ে যায় বাবা। বাণীচক্রে। তুতুল, আমার বোন, আর আমার বড়মাসির মেয়ে সোনাই, ওরা রবীন্দ্রসঙ্গীত। পূর্ণিমাদি আসে বাড়িতে। বিশ্বভারতীর। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী। চাঁদের হাসি’ আর অশ্রুনদীর সুদূর পারে’ শেখায়। আর সেই গানটা। নিঠুর হে’। একেবারে ছিন্নমূলের মতো এসে পড়েছিল ওরা ব্যান্ডেলে। পূর্ণিমাদির বাবা আর পূর্ণিমাদি। কোথা থেকে কে জানে। বিহার নাকি ইউপি থেকে। পূর্ণিমাদির মা ছিল না। একটা টালির ঘরে ভাড়া থাকত ওরা। পূর্ণিমাদির তখন চল্লিশের কাছে বয়েস। বিয়ে হয়নি। অথচ কত ফর্সা। অল্প দামের ছাপা শাড়ি কী সুন্দর করেই যে পরত। আমরা পূর্ণিমাদির পাত্র খুঁজতে ব্যান্ডেল স্টেশন যেতাম। আমরা তিন বোন। তুতুলের অনেক ট্রেনের কাকু ছিল। তাদের মধ্যে একজন, বিপত্নীক ও এক-বাচ্চার বাবা, পূর্ণিমাদির গায়ের রঙ শুনে আমাদের বাড়ি আসার শনিবারের বিকেলটি স্থির করে ফেলল। পূর্ণিমাদির লজ্জা-লাল গাল দুটিতে কল্পচন্দনের কল্কা আঁকতে আঁকতে ফিরে আসি আমরা। সানাই-এর বদলে কণিকার গাওয়া দূরে কোথায় দূরে দূরে’ যেন ঘুরে ঘুরে বাজতে থাকে আমাদের মনো সরণীর চৌহদ্দিতে।

শনিবার সকালেই খবরটা এল। পূর্ণিমাদি ভ্যানিশ। পাড়ারই এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের সঙ্গে। ডাক্তারের খেঁচুটে বউ সাতসকালে বাড়ি বয়ে পূর্ণিমাদি'র ভালোমানুষ বাবার বাপান্ত করে গেল। দুঃখে নাকি অপমানে কে জানে, মানুষটা আর বাঁচলও না বেশিদিন। আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল, একটা গান। একটা শেষ না হওয়া গল্প। তারপরও তুতুল গাইত গানটা, আর আমি ভেবে পেতাম না, কেন ওই গানের নিঠুর’ আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে যাচ্ছে। কেন সে আমাদের নিষ্ঠুরতাকে চাবুকে সোজা করছে না? এখন যত দিন যাচ্ছে, ভেতরের অন্ধকার জুড়ে বসছে দুচোখে, ততই মনে হচ্ছে, কেউ এসে লাথি কষাক পেছনে, ধাক্কা মেরে ফেলে দিক অতল অনিঃশেষ ব্ল্যাকহোলের মধ্যে। আর রক্ত-ঘাম ধুলোয় মিশিয়ে একফোঁটা আলোর দিকে উঠে আসার চেষ্টা করে যাই আজীবন। ওই আলোক বিন্দুটুকুই তো সে। যে আমার সমস- কালোকে আগুন করে তুলবে। যে আমাকে আঘাত দিয়ে পরশ’ করবে, স্পর্শমণির মতো। সেই নিঠুর।

 

 

ইনটারনেটে বাঙালি কবিদের উপস্হিতি / মলয় রায়চৌধুরী

September 30, 2011
blog comments powered by Disqus
blog comments powered by Disqus

Categories

Recent Posts